কর্ণফুলীকে পলিথিনমুক্ত রাখতে সংসদীয় কমিটির পরামর্শ কাজে লাগান

| রবিবার , ৩০ মে, ২০২১ at ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে কর্ণফুলী নদীর ভূমিকা অপরিসীম, যা এক কথায় অতুলনীয়। এটি দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন হিসেবে খ্যাত। কিস্তু সেই কর্ণফুলী নদীর এখন বড়ই করুণ দশা। প্লাস্টিক-পলিথিন জমে নদীর গভীরতা কমে গেছে অনেক। পলিথিন আগ্রাসনে এবং নানা ধরনের অপচনশীল বর্জ্যে কর্ণফুলী নদীর প্রায় ২০ ফিট গভীরতা কমে যাওয়ায় জটিলতা বাড়ছে। এছাড়া নদীর তীরবর্তী ৩০০ কলকারখানা ও শিল্প-প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য প্রতিনিয়ত নদীতে পড়ায় পানি মারাত্মক দূষিত হয়েছে।
কর্ণফুলীর এহেন দুর্দশা নিয়ে গত ২৫ মে দৈনিক আজাদীতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘কর্ণফুলীর বুকে পলিথিনের চর’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্ণফুলী নদীতে প্রতি মাসে দেড় কোটিরও বেশি পলিথিন পড়ছে। এতে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ রকমের জঞ্জাল। এছাড়া নদীর তলদেশে ২৫ ফুটের পলিথিন আস্তরণের কোনো সুরাহা না হওয়ার আগেই প্রতিদিন পড়ছে আরো লাখ লাখ পলিথিন। এতে তৈরি হচ্ছে নতুন সংকট। ইতোমধ্যে প্রতিটি খালের মুখ ঘিরে পানির উপরে তৈরি হয়েছে পলিথিনের বিশাল স্তূপ। যেন কর্ণফুলীর বুকে তৈরি হয়েছে ‘পলিথিনের চর’। খাল-নালা হয়ে নদীতে পড়া এসব পলিথিন শুধু কর্ণফুলীতে নয়; বঙ্গোপসাগরেও ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি করছে। নদীর পানিতে বিপুল পরিমাণ পলিথিন ভাসমান অবস্থায় আস্তরণ সৃষ্টি করছে। যা নদীর জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস করছে। এছাড়া এসব পলিথিনের জঞ্জাল অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত কর্ণফুলীকে ক্রমে মেরে ফেলছে। নগরীর পলিথিন জঞ্জালের ব্যাপারে বিশেষ পদক্ষেপ এবং নাগরিক সচেতনতা তৈরি না হলে চট্টগ্রামের এই নদী রক্ষা করা কঠিন হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন।
বাস্তবিক অর্থে দখল, ভরাট, বর্জ্য, পলিথিনসহ নানাভাবে কর্ণফুলীকে হত্যা করার মহাযজ্ঞ চলছে। জানা যায়, কর্ণফুলী নদীর ওপর শাহ আমানত সেতু নির্মাণের আগে ১৯৯০ সালে উত্তাল কর্ণফুলীর প্রস্থ ছিল প্রায় ৯০০ মিটার। সেতু হওয়ার পর থেকে চর জমার পাশাপাশি আশপাশে পাকা অবকাঠামো নির্মাণ করে ব্যাপক হারে ভরাট ও দখল করা হয়েছে নদীটি। ফলে সেতু এলাকায় নদীর প্রশস্ততা নেমে এসেছে অর্ধেকে। অব্যাহত নাব্য হ্রাসে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা খ্যাত সদরঘাট ১নং জেটি থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকায় পড়েছে বিশাল চর। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি সমপ্রসারণ করা যাচ্ছে না। কয়েক বছর ধরে এখানে জাহাজ চলাচলও সীমিত। এছাড়া কর্ণফুলীর পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে আড়াইশ’রও বেশি স্থাপনা। রাঙামাটির চন্দ্রঘোনা থেকে পতেঙ্গাস্থ কর্ণফুলীর মুখ পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার স্থানজুড়ে যে ৩০০টি কারখানা কিংবা শিল্পস্থাপনা রয়েছে, সেসবের বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। অভিযোগ আছে, পেপার মিল, তেল শোধনাগার, পাওয়ার প্ল্যান্ট, ট্যানারি, সার প্রস্তুতকারক, সাবান এবং সিমেন্ট কারখানাসহ অন্তত ৮৪টি কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। মারাত্মক ক্ষতিকর সব বর্জ্যের ভারে কর্ণফুলীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্ণফুলী নদী দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী স্যুয়ারেজ বর্জ্য।
আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের ৭০ লাখ মানুষের অর্ধেকও যদি সপ্তাহে একটি পলিথিন ব্যবহার করে তাহলে মাসে ব্যবহৃত পলিথিনের সংখ্যা দাঁড়ায় দেড় কোটির কাছাকাছি। এই বিপুল সংখ্যক পলিথিনই নদীর তলদেশে ২৫ ফুটের পলিথিন আস্তরণ তৈরি করেছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন না করলে নদীর তলদেশে এই ধরনের পলিথিন স্তরের ভয়াবহ খবরই মানুষের অজানা থেকে যেতো।
এদিকে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ পলিথিনমুক্ত রাখতে নদীর সংযোগে থাকা খালগুলোর মুখে নেট বসানোর পরামর্শ দিয়েছে সংসদীয় কমিটি। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় বন্দর কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি, চট্টগ্রাম বন্দরের বিস্ফোরক ও ঝুঁকিপূর্ণ দ্রব্যাদির মজুদ, রক্ষণাবেক্ষণ, হ্যান্ডলিং ও পরিবহন আইন এবং নীতিমালা সম্পর্কে আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে কমিটির সদস্য সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, কর্ণফুলী নদীতে যেসব খাল দিয়ে এই বর্জ্য আসে সেই খালগুলোর সাথে নদীর সংযোগস্থলে নেট দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। সেখানে স্লুইস গেট করুক বা যাই করুক, সেখানে পলিথিন পরিষ্কারের লোক লাগবে। কথা ছিল সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এটা পরিষ্কার করবে। মন্ত্রণালয় এ নিয়ে মিটিংও করেছিল। কিন্তু ফলপ্রসূ কিছু পাওয়া যায়নি। এজন্য বলা হয়েছে বন্দরের টাকায় এই কাজটি করা হবে।
আমরাও চাই, সংসদীয় কমিটির পরামর্শ যেন কাজে লাগে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন-সেই প্রত্যাশা আমাদের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে