আজ জাতীয় নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। ১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার এই দিবস পালন করে আসছে। নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস ও নবজাতকের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু গতবারের মতো এবারও করোনার প্রভাবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সীমিত আকারে দিবসটি পালন করতে হচ্ছে।
আমরা জানি, এ দেশের অনেক মা অপুষ্টি ও রক্তশূন্যতায় ভোগেন, যা মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। এর পেছনে রয়েছে প্রচলিত কিছু সামাজিক কুসংস্কার। যেমন, অনেক গ্রামে অনেক পরিবারে গর্ভকালীন হাঁসের গোশত, মুরগির ডিম, মৃগেল মাছ ও কচুশাকসহ অনেক পুষ্টিকর খাবার খেতে দেওয়া হয় না। এমনকি গর্ভকালীন মায়েদের শারীরিক ও মানসিক পরিচর্যার ক্ষেত্রেও অবহেলা করা হয়। বরং অনেক সময় তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়, পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া হয় না। কর্মজীবী নারীদের সমস্যা আরও প্রকট। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি থাকলেও বেসরকারি পর্যায়ে মায়েরা অনেক ক্ষেত্রেই এখনও ছুটি থেকে বঞ্চিত। অবশ্য কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ছুটি দেওয়া হলেও বেতন মিলছে না। বিশেষ করে পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই আচরণ বেশি হচ্ছে; এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার।
এদিকে, মাতৃমৃত্যু কমাতে মিডওয়াইফ বা ধাত্রীদেরকে পিলার হিসেবে গণ্য করা হয়। যারা পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও সন্তান প্রসবকালীন সময়ে দক্ষ প্রসব সহায়তাকারীর মাধ্যমে প্রসব করানোর সেবা সমপ্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ সরকার মিডওয়াইফ এর মাধ্যমে নিরাপদ মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি এবং জরুরি প্রসব সেবাসহ প্রসবকালীন জটিলতায় সঠিক রেফারেল সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশ জাতীয় মাতৃস্বাস্থ্য কৌশল (২০১৯ থেকে ২০৩০) অনুযায়ী সরকারের টার্গেট হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ৪৭.১% থেকে ৮৫% এ উন্নীত করা এবং দক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে প্রসবের হার ৫০% থেকে ৯০% এ উন্নীত করা। পাশাপাশি এ কৌশলের আরও একটি লক্ষ্য হলো মাতৃমৃত্যুর হার ১৭২ থেকে ৭০ এ হ্রাস করা (প্রতি ১০০০ জীবিত জন্মে) এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার ১৭ থেকে ১২ তে কমিয়ে আনা। পাশাপাশি গর্ভকালীন সময়ে কমপক্ষে ৪ বার গর্ভকালীন সেবা গ্রহণের হার ৩৭.২% থেকে ১০০% উন্নীত করা।
সকল নারীদের নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মিডওয়াইফদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং প্রমাণভিত্তিক অনুশীলনের মাধ্যমে মিডওয়াইফদের মাধ্যমে নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধি, নিরাপদ প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং সবার জন্য পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও দাতা সংস্থা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, নারী জীবনে গর্ভকাল অন্য সময়ের চেয়ে আলাদা। এ সময় একই দেহে দু’টি প্রাণের বসত। জন্মদান প্রক্রিয়াও জটিল। আমাদের দেশে প্রসবকালে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার আগের তুলনায় অনেক কমেছে, কিন্তু এখনও যে পর্যায়ে আছে তাও উদ্বেগের। গর্ভকালীন মাকে বাড়তি যত্ন নিতে হবে তার পরিবারকে। মায়ের ও অনাগত শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপশি জটিল কোন সমস্যা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে জরুরিভাবে গর্ভবতীকে নিয়ে শরণাপন্ন হতে হবে মা ও শিশু চিকিৎসকের। এছাড়াও গর্ভকালীন সময় টিটি টিকা দেয়া, ওজন মাপা, স্বাস্থ্য শিক্ষা দেয়া, রক্তস্বল্পতা বা শরীরে রক্ত কম কি-না তা পরীক্ষা করা, রক্তচাপ পরিমাপ করা, পা অথবা মুখ ফোলে গেলে পানি আছে কি-না দেখা, শারীরিক অন্য কোন অসুবিধা আছে কি-না তা পরীক্ষা করা, পেট পরীক্ষা করা, উচ্চতা মাপা ইত্যাদি নিয়মিত পরীক্ষা করা জরুরি।
স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলেন, বস্তুত মায়ের সুস্থতার ওপর নির্ভর করে সন্তানের নিরাপদ জন্ম ও সুস্থ জীবন। তাই মায়ের স্বাস্থ্য ও সুস্থতা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিরাপদ স্বাস্থ্য মায়ের অধিকার। আর এ অধিকার আদায়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সমাজসচেতন সবাইকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।