লাল ফেরারিতে পতাকার লাল
মুখের কথা আমার শেষ হতে না হতেই, খুব মনোযোগে ফেরারি দেখতে ব্যস্ত অভ্র, মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘হোয়াই দে অয়ার চিটিং, বাবা?’ ওর চোখমুখের কুঁচকানো ভাব আর প্রশ্নটি ইংরেজি সংস্করণে হওয়ায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেল ব্যাপারটা যে মোটেও পছন্দ হয়নি অভ্রর শুধু তাই ই নয়, রেগেও গিয়েছে এতে।
‘আরে বোকা আঙ্কেলরা তেল মারছিল বুঝতে পারছ না কেন?’ বেশ বিজ্ঞের ভঙ্গিতে বলল দীপ্র। চোখে মুখে দেখলাম এক ধরণের আত্মতৃপ্তির আভাস, বলছে যা নিঃশব্দে, তুমি তো ছোট তাই বুঝতে পারছ না। আমি তো বড় হয়েছি তাইতো বুঝেছি বড়দের এইসব ভুজং ভাজুং।
‘নো, দে আর ফেইকিং? ইটস ব্যাড’ বড় ভাইয়ের জবাবে অভ্র জানালো ফের এ নিয়ে তার তীব্র অনীহা!
এদিকে আমার মনের এখন স্যান্ডুইস অবস্থা ! মানে প্রথমে অভ্রের প্রশ্নে ঘাবড়ে গেলেও, দীপ্রর উত্তর তাতে একটু হাফ ছাড়ানোর ক্রিম মাখাতে না মাখতেই, অভ্রর উপসংহারে ফের গেলাম ঘাবড়েই। ভাবলাম আসলেই তো, অভ্রর ঐ কঠিন প্রশ্ন আর উপসংহারটিকে তো অস্বীকার করার কোনই উপায় নেই!
এরকম স্যান্ডুইস অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম মনে, বিদেশি কান্ট্রি হেডের নাম ইতিমধ্যে বলে ফেললেও, বাকি কারোর নাম বলা চলবে না। কারণ তাহলে ওনাদের কাউকে কাউকে চিনে ফেলতে পারে, যাদেরকে দীপ্র তৈলবাজ হিসাবে চিহ্নিত করলেও, অভ্র চিহ্নিত করেছে যাদের প্রবঞ্চক হিসাবে। পরবর্তীতে তাদের কারো সাথে কখনো দেখা হয়ে গেলে, মুখে হয়তো কিছুই বলবে না দু ভাই, কিন্তু সহজও তো হতে পারবে না তাদের সাথে। এরকম ভাবতে ভাবতেই মনে হলো, হায়রে এভাবেই তো চলছি আমরা সবাই , আর তাতেই চলছে সমাজ নিরন্তর! বাচ্চাদের সারাক্ষন নানান নীতিকথা শিখিয়ে, নিজেরা করি যাবতীয় নীতিহীনতার চর্চা! তারপর আবার সেটা ঢাকার জন্য লাগাই মুখে কতো নানান রঙের মেকআপ, পরি নানান মুখোশ।
“আচ্ছা বাবা কি হল তারপর?” দীপ্রর এই প্রশ্ন এসময় আমাকে সেই স্যান্ডুইস নাকি ত্রিশংকু অবস্থা থেকে বার করে আনায়, হাফ ছেড়ে বাঁচার ভাব আসতেই; একটা জোর শ্বাস টেনে বেইজিং এর হিমসাগর থেকে একবুক হাড়হিম করা ঠাণ্ডা হাওয়া নিয়ে ফের দিলাম মন গল্পে।
হ্যাঁ বলছিলাম যা, ৯২ কি ৯৩ সালের ঐরকম কোন একদিন অফিসে একটা জরুরি সইয়ের জন্য আমার বসকে খুঁজতে খুঁজতে, খুঁজে পাই গিয়ে তাকে সেই বোর্ডরুমে। উনি তখন আরো কয়েকজন মিলে ফর্মুলা ওয়ান রেসিং দেখছিলেন দোয়েগি সাহেবের সাথে। সাহেব টগবগ করছিলেন মহা উত্তেজনায় । আনন্দে উনি হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করলে, বাকিরাও এক যোগে হই চই করে উঠছিলেন । আর উনি মন খারাপ করলেই, তারাও উহ আহ করে মুখ বেজায় রকম কালো করে ফেলছেন । মিঃ দোয়েগির চোখ টিভির পর্দায় এক্কেবারে আঠা দিয়ে লাগানো থাকলেও, বাকিদের চোখ রাখছিল বসের ভাবভঙ্গির উপর তীক্ষ্ণ নজর।
তো বোর্ড রুমে ঢুকেই ওরকম একটা অবস্থা দেখে বুঝলাম, ঐ মুহূর্তে বেশ উত্তেজনাকর অবস্থায় আছে রেসিং। অতএব ঐ সময় আমার কিছু বলাটা ঠিক হবে না। এতে যার যেদিকেই মনোযোগ আছে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারনে তুমুল বিরক্ত হতে পারেন সবাই। ভাবলাম ঐমুহূর্তে তাই যে, রেসিং এর কিছু বুঝি বা না বুঝি তাতে কিছু যায় আসে না; আমারও উচিৎ হলো তখন ঐ টেলিভিশনের দিকেই তাকিয়ে থাকা। আর করলামও তাই ই চুপচাপ। এভাবে মিনিট পাঁচ কি সাত পর মিঃ দোয়েগি,একই সাথে দুহাত মাথার উপরে তুলে ভিক্টরি চিহ্ন দেখিয়ে, চেয়ার ছেড়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। সাথে সাথে বাকিরা তাকে কনগ্র্যাচুলেট করতে শুরু করলো দ্বিগুণ চিৎকারে, লাফিয়ে! ব্যাপারটা অনেকটা ঐরকম, যে রকম করি আমরা বাসায় নিজেদের মধ্যে, ক্রিকেটের টাইগার বাহিনী জিতে গেলে কোন খেলায়।
সে যাক বোর্ড রুমের সেই আনন্দ উত্তেজনা শেষ হতেই, মিঃ দোয়েগি সবার উদ্দেশ্যে বললেন ‘ইউ নো মাইকেল সুমাখার অন ফেরারি ইজ আনবিটেবল উইনিং কম্বিনেশন’। সেই প্রথম ফেরারি নামের গাড়ীর খবর জেনেছিলাম আমি।
‘কি বল বাবা ? তার আগে তুমি জানতেই না, ফেরারির কথা?’ আমার এহেন গ্রাম্যতা নাকি পশ্চাৎপদতায় বেশ হতাশ দীপ্রকে চাঙ্গা করার জন্যই কি না জানি না, এ সময় অভ্র বলে উঠলো -‘বাবা আমাদের একটা ছবি তুলে দাও এখানে।’ অতঃপর ভাইয়ার পাশে গিয়ে এমনভাবে দাঁড়ালো ও নিজে, যাতে বোঝা যায় যে দাঁড়িয়ে আছে তারা চকচকে নতুন এক ফেরারির সামনে।
নাহ বাবা এখন না। এই রাতের বেলার অন্ধকারে ছবি তেমন ভাল উঠবে না। আর ঐ তোমাদের পেছনের শো রুমের ঐ কাঁচটাতে ফ্ল্যাশ রিফ্লেক্ট করবে। আমরা তো আছিই এখানে। দিনের বেলা যখন শোরুম টা খুলবে, তখন ভেতরে গিয়েই তুলো ছবি । এখন চল যাই আমরা রুমে। এ কথা বলতেই দুজনেই ডান দিকে হোটেল থেকে প্রায় শ খানেক মিটার দূরের পাশরাস্তাটির ওপাশের শোরুম দুটো দেখিয়ে সমস্বরে বললো
‘চলো না বাবা ঐ গাড়িগুলো একটু দেখে আসি কাছ থেকে।’
ঠিক আছে চলো, বলেই দুজনকে দু হাতে ধরে সেইদিকেই ধরলাম হাঁটা। হোটেলের চৌহদ্দি পেরিয়ে ঐ পাশরাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে , ছোটবেলায় শেখা রাস্তা পার হওয়ার নিয়ম অনুযায়ী ডানে বায়ে তাকিয়ে দেখতে পেলাম না কোন গাড়ি বা মানুষের নামনিশানাও । বুঝলাম হোটেলের সামনের ব্যস্ত মূল সড়কের পেট থেকে লম্ব আকারে বেরিয়ে আসা এ রাস্তাটি এ মুহূর্তে ঘুমুচ্ছে। অতএব পার হওয়া যায় তা নির্দ্বিধায়। তারপরও সাথে সাথেই পা না বাড়িয়ে ডানে ফের তাকালাম জেব্রা ক্রসিং এর খোঁজে।
নাহ, ডানে তা নেই দেখে বা দিকে ঘাড় ঘোরাতেই চোখে পড়লো কালো পিচের উপরে হলুদ ডোরা নিয়ে হাত পা ছড়িয়ে লম্বালম্বি শুয়ে থাকা জেব্রা ক্রসিংটা, যেটা পেরিয়ে ফুটপাত উঠে তা পেরুলেই গিয়ে হাজির হবো খানদানি গাড়ি এস্টনমার্টিনের ঝলমলে শো রুমের বারান্দায় । যার থেকে আবার মিটার বিশ কি ত্রিশ দূরে আছে আরেক সৈয়দবংশীয় গাড়ি মাজারতি আলয়।
দ্রুত পা চালিয়ে রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাতে উঠতেই , দুই ঝটকা মেরে দুই পুত্র দুই হাত মুক্ত হয়ে দিল ভোঁ দৌড় এস্টনমার্টিনের দিকেই । দু জনের এই টগবগে উত্তজেনায় ঠোঁটে নিঃশব্দ হাসি ফুটে উঠলেও, মনে মনে ভাবলাম , হায় এ কি করে হয়? আমারই আত্মজদের এই গাড়ি বিষয়ক তুমুল আগ্রহের কথা টেরই পেলাম না এতদিন ! গাড়ি ফারি নিয়ে ঘরে কেউ কখনও কোন আলোচনা করেছি বলে তো মনে পড়ছে না ।
অবশ্য যদিও জানি রুমে রুমে ২৪ ঘণ্টা জাগ্রত, শতাধিক চ্যানেলের টিভি আর সর্বক্ষণ ইন্টারনেটের হাইওয়ে খোলা থাকায়, আজকাল কোন খবরই কারো আর অজানা থাকার জো নেই, যদি থাকে কোন কিছু নিয়ে ঐরকম আগ্রহ। তারপরও কেন বুঝতে পারছি না কবে থেকে ওরা এইসব নানান সৈয়দ , খান বাহাদুর , রায়বাহাদুর বংশীয় যাবতীয় গাড়ি বিষয়ে এরকম বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলো ? এ নিয়ে কেমন একটা অস্বস্তির খোলসে খোলসবন্দি ধীরে সুস্থে হেঁটে গিয়ে ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে নিজেও উঁকিঝুকি দিয়ে ভাল করে দেখার মার্টিনসাহেব কে দেখতে দেখতে বললাম , বাবা ঠাণ্ডা লাগছে না তোমাদের, চলো এবার ঐ গাড়িটা দেখতে, তারপর রুমে ফিরতে হবে আমাদের। আর আগেই তো বলেছি ছবি টবি তোলা হবে এগুলোর সাথে, আগামি তিন দিনের যে কোন সময় দিনের বেলায়। আর শো‘রুম খোলা থাকা অবস্থায় এলে ভেতরে গিয়ে ভাল করে দেখেও নিতে পারবে।
কাজ হল কথায়। দুজনেই দিল দৌড় বাঁয়ে সেই মাজারাতিআলয়ের দিকে। আসলে এরকম খানদানি বংশীয় গাড়ীর শো রুমকে, শো রুম না বলে আলয়, বা প্রাসাদই বলা যথাযোগ্য হয়। যেরকম জাঁক এদের এই আলয়গুলোর তাতে এগুলোকে শো রুম বললে ট্রাক্টর বা মোটর সাইকেলের শো রুমের সাথে পার্থক্য থাকে আর কোথায়?
সেযাক এতোক্ষণ বেইজিং হিমের তুমুল প্রকোপের মধ্যে বাইরে থাকার কারনেই হউক , কিম্বা ঐ যে আগামি তিনদিনের যে কোন একদিন, দিনের বেলায় এসে এই গাড়িগুলো ভাল করে দেখিয়ে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম , এই দু কারণের যে কোনটির বা দুটোর মিলিত কারণেই হউক, ধীরে সুস্থে হেঁটে আমি গিয়ে মাজারাতি আলয়ের সামনে দাঁড়াতেই, দীপ্র বললো “চলো বাবা, আমাদের দেখা হয়ে গেছে” যাতে দ্বিরুক্তি করল না অভ্রও ।
দুপাশে দুজনকে জড়িয়ে ধরে ফিরতি হাঁটা ধরতেই, দীপ্র বলল “আচ্ছা বাবা তুমি একটা রিয়েল ফেরারি গাড়ি প্রথম কবে দেখেছিলে ?”
বুঝলাম আমি যে ওদের তুলনায় অনেক দেরিতে ফেরারি চিনেছি, এ ব্যাপারটা দীপ্রর হজম করতে অসুবিধা হচ্ছে। আসলে এখন ও যে বয়সে আছে , তাতে সম্ভবত এখনো তার বাবাই তার সবচেয়ে বড় নায়কই। এ এক নিদারুণ সত্য যে শিশু পুত্রদের কাছে বাবারা অপ্রতিরোধ্য নায়ক থাকলেও, বাবাদের সেই নায়কের সিংহাসন আস্তে আস্তে টলতে থাকে যতই পুত্ররা বড় হতে থাকে। এরকম হতে হতে একসময় তো সেই নায়ক পিতাই, পুত্রদের কাছে এক্কেবারে সেকেলে মানুষ না শুধু, কোন কোন ক্ষেত্রে তো এক্কেবারে অপদার্থই হয়ে যায়। বিখ্যাত বাবাদের ক্ষেত্রে এ নিয়মের ব্যতিক্রম হলেও, সাধারণ আমার জন্য সাধারণ নিয়মই প্রযোজ্য ।
এসব ভাবতে ভাবতে সেই হলুদ ডোরাকাটা জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হতে হতে বললাম, দেখেছি সেটা সম্ভবত ৯৮ সালের দিকে সিঙ্গাপুরে। সেবার যে হোটেলে ছিলাম সেই হোটেলের সামনে একটা হলুদ ফেরারি দেখে চমকে উঠেছিলাম। ছবিও তুলেছিলাম সেটার পাশে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকটা। আর লাল ফেরারি প্রথম দেখেছি, তোমার জন্মের বছর । কারণ সেবারই আমি গিয়াছিলাম ইতালিতে ।
যদিও সেই যে বোর্ড্রুমের টিভিতে দেখেছিলাম মাইকেল শুমাখারের ফেয়ারিটি ছিল লাল রংয়ের, সেই থেকে সেই কারণ ছাড়াও আরো একটা কারণে ফেরারি মানে লাল রং ছাড়া অন্য কোন রং আমার মনে আসে না।
“না তা হবে কেন? তবে তোমার সেটা মনে হতো কেন?” প্রশ্ন এবার অভ্রর -শোন চাকুরিতে যোগ দেবার পর থেকেই আমি ভাবতাম, আচ্ছা আমার কোম্পানির মত আরো সব বিদেশি কোম্পানিগুলোর সব বড় বড় পজিশনে, বিশেষত কান্ট্রি হেড পজিশনে কোন বাংলাদেশি নাই কেন? এ নিয়ে আমার খুব মন খারাপ হতো, বিরক্ত লাগতো সেই শুরু থেকেই। তা ঐ মাইকেল শুমাখারের লাল ফেরারি টিভিতে দেখার বেশ কিছুদিন পর একদিন কোম্পানির একটা পুরানো নিউজলেটার নাকি কোন একটা বই ঘাটতে ঘাটতে জানতে পারলাম যে একজন বাংলাদেশি ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ার, উনি ঐ ফেরারি গাড়িতে, ফেরারি রেড নামের যে বিখ্যাত লাল রং টি ব্যবহার করা হয় সেই আবিষ্কারকদের দলের একজন! আর এই রংটির বিশেষত্ব হল অন্য সব রং রোদে, মানে সূর্যের আলট্রাভায়োলেট রে এর কারণে জ্বলে হাল্কা হয়ে গেলেও, এই রংয়ে তা হয় না। সেই বিজ্ঞানির নাম হলো ড. ইকবাল।
আর এ আবিষ্কারের কারণে কোম্পানি ওনাকে পরবর্তিতে শুনেছিলাম সম্ভবত পুরো ইউরোপেরই হেড বানিয়ে দিয়েছিল; যেহেতু তাঁর এ আবিষ্কার কোম্পানির কেমিকেল ডিভিশনের ব্যবসা আর লাভ দুটোই বাড়িয়েছিল। এ খবরটি পড়ার পর এরকমই গর্ব হচ্ছিল যেনবা, আমিই করেছি ঐ আবিষ্কার! কারণ ড. ইকবাল যেই বাংলাদেশের সন্তান, আমিও তো সেই মাটিরই।
সেই থেকে ফেরারি বলতেই আমার মনে ভেসে উঠে শুধুই লাল রংয়ের ফেরারি। আর ভাবি ফেরারির লাল রং মানে তো ওতে লেগে আছে আমার পতাকার লালেরই ছোঁয়া। এ কথা বলতে বলতে হোটেলে ঢোকার চক্রাকার স্বয়ংক্রিয় দরজা ভেতরে তিনজনে ঢুকছি যখন, আনন্দিত দীপ্র বললো -‘ওয়াও’।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক