চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প নিয়ে নানা রকম উদ্বেগ বিরাজ করছিলো সংশ্লিষ্টদের মনে। কেননা, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আইনি জটিলতার কারণে প্রায় পাঁচ বছর বন্ধ থাকে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ। গত ২০ মে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে নতুন গতি’ শীর্ষক সংবাদটি প্রকৃত অর্থে আশার সঞ্চার করেছে। এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প গতি পেয়েছে। ফলে কর্ণফুলী নদীর গভীরতাও বাড়ছে বেশ। এক বছরেরও বেশি সময়ে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ ৩০ শতাংশের ধারে কাছে ঘুরলেও গত এক মাসেই অগ্রগতি পেয়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। এতে নদীর পানি ধারণক্ষমতাও বেশ বাড়ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নগরীর খালগুলো পরিষ্কার করা হলে জলাবদ্ধতা নিরসনে ভালো সুফল মিলবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় কর্ণফুলী নদী থেকে ৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এতে আরো বলা হয়, কর্তৃপক্ষ আইনি জটিলতা এড়িয়ে নদী থেকে ৪২ লাখ ঘনমিটার মাটি উত্তোলনের জন্য ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং’ নামের পৃথক একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ২৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন এই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হলেও কার্যত এটি কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প। প্রকল্পটির আওতায় সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার চওড়া এলাকায় ড্রেজিং করার কথা। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর মাধ্যমে চীনা কোম্পানি ই-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পটির কাজ করছে। বেশ উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে প্রকল্পটির কাজ শুরু হলেও পলিথিন জঞ্জালে সব আয়োজন যেন ভুণ্ডুল হওয়ার উপক্রম হয়। কর্ণফুলীর তলদেশে ২০ ফুটের বেশি পলিথিন আস্তরের ফলে ড্রেজার দিয়ে মাটি ও বালি উত্তোলন ব্যাহত হয় মারাত্মকভাবে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
মোট কথা, পলিথিন উত্তোলনে অভিজ্ঞতা না থাকার কারণেও ড্রেজিং কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্ণফুলী নদীতে বর্জ্য ও পলিথিন পড়া বন্ধ না করলে এসব ড্রেজিং প্রকল্প তেমন কাজে আসবে বলে মনে হয় না। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ওয়াসার কোনো পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় পলিথিনসহ নগরীর প্রায় ৬০ লাখ বাসিন্দার বর্জ্য ৩৬টি খালের মাধ্যমে সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে পড়ে। চট্টগ্রাম ওয়াসার হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ৩ লাখ লিটার গৃহস্থালি বর্জ্য, কয়েকশ টন শিল্প কারখানার ক্যামিকেল পড়ে এ নদীতে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির সাথে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ টন পলি গিয়ে পড়ে এ নদীতে। মানুষের বর্জ্য, পলিথিন ও পলি মিলে কর্ণফুলী নদীতে প্রায় ১০ মিটার পলিথিনের স্তর সৃষ্টি হয়েছে যা ড্রেজিং কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ কথা ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও নানা সময়ে স্বীকার করেছেন। বলেছেন, কর্ণফুলী নদীতে জমে থাকা পলিথিনের কারণে ড্রেজিং প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সাথে বেড়েছে বর্জ্যের পরিমাণ। ২০১৮ সালে যখন নতুনভাবে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় তখন বর্জ্যের পরিমাণ ধরা হয়েছিলো ৪২ লাখ ঘনমিটার। আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ লাখ ঘনমিটার। বর্জ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং তা সরানোর জন্য বেড়েছে প্রকল্প ব্যয়।
তাঁরা আরো বলেন, গত ১২ জানুয়ারি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় কর্ণফুলী ড্রেজিং প্রকল্পের সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) পাশ হয়। প্রকল্পের ব্যয় ২৫৮ কোটি টাকা থেকে ৬৩ কোটি টাকা বেড়ে ৩২১ কোটি টাকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ অগ্রসর হচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত প্রায় ৩.৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার চওড়া এলাকায় ড্রেজিং করার কথা। ড্রেজিং থেকে উত্তোলিত বালি ও মাটি নগরীর হামিদচর এলাকা ভরাট করার কাজে ব্যবহৃত হবে। ফলে বালু তুলে বর্জ্য বোঝাই করে সেখানে নিয়ে যাওয়ারও খরচ বেড়েছে।
দেশের ৯২ ভাগ আমদানি-রপ্তানি সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। কর্ণফুলী নদী দেশের অর্থনীতির প্রাণ হিসেবে খ্যাত। কিন্তু সেটি ক্রমে ভরাট হয়ে যাচ্ছিল। কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষেই এই বন্দরের জেটি, ইয়ার্ড এবং অন্যান্য স্থাপনার অবস্থান। সে কারণে কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা স্বাভাবিক মাত্রায় রাখা বন্দর এবং অর্থনীতির জন্য খুবই জরুরি। তাই ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের গতি আরো বেশি পরিমাণে সঞ্চারিত হোক-সেটিই সবার প্রত্যাশা।