উপাচার্য নিয়োগে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহ্য অনুসরণে বাধা কোথায়?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য আবদুস সোবহানের নিয়োগের মেয়াদের সমাপ্তিপর্বে তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহারের হিড়িক এবং ছাত্রলীগের অন্যায় জবরদস্তির যে ভয়াবহ বর্ণনা দৈনিক প্রথম আলোর ৭ মে ২০২১ তারিখের হেডলাইন সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে তা পাঠের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক হিসেবে আমার লজ্জা, হতাশা ও গ্লানি জাতিকে জানানোর জন্যই কলামটি লিখছি। এমনিতেই বেশ কয়েক মাস ধরে উপাচার্য আবদুস সোবহান মরিয়া হয়ে তাঁর উপাচার্যের ক্ষমতার বেলাগাম অপব্যবহারের একটা ন্যক্কারজনক ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করে চলেছিলেন। তাঁর মেয়ে এবং জামাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতার ঘাটতি থাকায় তিনি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যোগ্যতার শর্ত শিথিল করে তাদেরকে শিক্ষক নিয়োগের মত লজ্জাকর নজিরও সৃষ্টি করে খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) তদন্ত কমিটি গঠন করলেও জনাব সোবহান কমিটির সাথে চরম অসহযোগিতা করেছেন। এতদ্সত্ত্বেও কমিটির প্রতিবেদন ইউজিসি চেয়ারম্যানের কাছে দাখিল করা হয়েছে, কিন্তু এর যৌক্তিক ধারাবাহিকতায় সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে উপাচার্যের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এর মাধ্যমে ইউজিসি’র দুর্বলতা যেমনি ধরা পড়েছে তেমনি প্রমাণ হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কিংবা আরো ওপরমহলে জনাব সোবহানের খুঁটির জোর হয়তো অনেক বেশি। ফলে, উপাচার্যের দ্বিতীয় মেয়াদের সমাপ্তি যতই ঘনিয়ে এসেছে ততই তাঁর বেপরোয়া কর্মকান্ডের বহর বেড়ে চলেছিল। এরই ক্লাইমেঙ দেখা গেল তাঁর শেষ কর্মদিবসে, ১৪১ জনকে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে অস্থায়ী নিয়োগ দিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ঘেরাও থেকে পুলিশ পাহারায় তিনি বীরদর্পে বেরিয়ে গিয়ে দেশের সব সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে গেলেন। (ঐ ১৪১ জনের মধ্যে ছাত্রলীগ এক তৃতীয়াংশের বেশি পদ বাগিয়েও সন্তুষ্ট ছিল না)। যেখানে নিয়মানুগভাবে উপাচার্যের দুই মেয়াদের দায়িত্ব পালন শেষে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রীদের শ্রদ্ধা-ভালবাসায় সিক্ত হয়ে তাঁর অফিস ত্যাগ করার কথা সেখানে তাঁকে পালাতে হলো পুলিশ পাহারায়!
উপরে বর্ণিত পুরো ঘটনাপ্রবাহ এদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সবচেয়ে দুরারোগ্য দুটো ব্যাধিকে জাতির সামনে আবারো নগ্নভাবে উন্মোচিত করে দিয়েছে। ব্যাধির মূল উৎস এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একাংশকে রাজনৈতিক দলগুলোর বশংবদ দালাল বানানোর প্রতিযোগিতা এবং লাঠিয়াল পালনের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ব্যবহারের অপসংস্কৃতি। এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একাংশ নানাবিধ পদের লোভে মূল রাজনৈতিক দলের সক্রিয় নেতা-কর্মীতে পরিণত হয়ে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ এখন আর শিক্ষকের পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হয় না, তদবিরের প্রতিযোগিতায় কার পারদর্শিতা কতখানি তারই ন্যক্কারজনক প্রদর্শনী হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাপারটা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর ঐ সময়ে দেশের বিদ্যমান চারটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ করেছিলেন। ঐ সময়ের সেরা পণ্ডিতদেরকে তিনি নিজে টেলিফোন করে রাজি করিয়েছিলেন উপাচার্য পদ গ্রহণের জন্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কিংবদন্তি প্রফেসর মুজাফফর আাহমদ চৌধুরী (ম্যাক)। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বানানো হয়েছিল প্রফেসর খান সারওয়ার মুরশিদকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর ইন্নাস আলী। কিন্তু তিনি তখনকার ছাত্ররাজনীতিকে সফলভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করার পর দেশবরেণ্য সাহিত্যিক প্রফেসর আবুল ফজলকে উপাচার্য হওয়ার জন্যে টেলিফোনে অনেক দেন-দরবার করে রাজি করিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার জন্যে বঙ্গবন্ধু আরেকজন দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. এনামূল হককে রাজি করিয়েছিলেন। প্রফেসর আবুল ফজল এবং ড. এনামূল হক দুজনেই সরকারি চাকরি থেকে বহুদিন আগেই অবসর গ্রহণ করা সত্ত্বেও জাতির পিতার অনুরোধে সাড়া দিয়ে দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরেছিলেন। পরবর্তীতে প্রফেসর মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে নবগঠিত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত করায় তাঁর স্থলে উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন দেশের আরেকজন খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুল মতিন চৌধুরী। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন ড. রশিদ। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন ড. শামসুল ইসলাম। বোঝা যাচ্ছে, যাঁরা তাঁর আমলে উপাচার্য হয়েছিলেন তাঁরা সবাই তাঁদের পাণ্ডিত্যের জন্যে সুপরিচিত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে জাতির পিতার এই নজিরগুলোকে আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। এই ঐতিহ্য তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনা সমুন্নত রাখতে পারলেন না কেন?
১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ এবং অন্য তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণীত হওয়ার পর ওগুলোর অধীনে উপাচার্য নিয়োগ শুরু হয়েছিল সমরপ্রভু জিয়া এবং স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের প্রথম উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে সর্বাধিক ভোট পেয়েছিলেন প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, দ্বিতীয় হয়েছিলেন প্রফেসর আহমদ শরীফ। কিন্তু, তাঁরা কেউ সরকার প্রধানের কাছে তদবির করতে রাজি না হওয়ায় যিনি তৃতীয় হয়েছিলেন তাঁকেই উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ঘটনা। মানে, এর মাধ্যমে সরকার প্রধানের কাছে তদবিরের মাধ্যমে উপাচার্য হওয়াটাই নিয়মে পরিণত হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট-নির্বাচিত উপাচার্য প্যানেলে আনিসুজ্জামান স্যার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর এরশাদের কাছ থেকে খবর এসেছিল স্যার একবার তার সাথে দেখা করলেই উপাচার্যের নিয়োগ পেয়ে যাবেন। স্যার ঐ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ১৯৯১ সালে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর এই নিয়মটা দলবাজ ও তদবিরবাজ শিক্ষকদেরকে পুরস্কৃত করার রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। এখন নূতন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ হয় না, প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ মোতাবেক আচার্য মহোদয় (মহামান্য রাষ্ট্রপতি) উপাচার্য নিয়োগ দেন। (ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচিত হলেও ঐ প্যানেল-নির্বাচনে সরকারি প্রভাবই মুখ্য ভূমিকা পালন করে)। ফলে, তদবিরের মাধ্যমে উপাচার্য পদ দখল এবং যেনতেনভাবে উপাচার্য উৎখাতের সংস্কৃতি ক্রমেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশের ধ্যানজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। একাজে তাঁদের সাঙাত ছাত্রনেতারা।
কিন্তু, বিশ্বস্বীকৃত সত্য হলো বিশ্ববিদ্যালয় নূতন জ্ঞান সৃষ্টির আলয়। অতএব, জ্ঞানের সর্বশেষ সীমান্তে গবেষণার মাধ্যমে নূতন জ্ঞান সৃষ্টির দায়িত্বটি আধুনিক বিশ্বের সব দেশেই জাতির সবচেয়ে মেধাবী সন্তানদের ওপর অর্পণের রীতি সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। সর্বোচ্চ মেধাবীরা যাতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় আকৃষ্ট হন এবং নির্বিঘ্নে তাদের শিক্ষকতা ও গবেষণায় ব্যাপৃত থাকতে পারেন সেজন্যে উন্নত ও উন্নয়নশীল প্রায় সব দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারের হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত রাখার ব্যাপারটি বিশ্ব-স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। একজন শিক্ষক নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শে কিংবা রাজনীতিতে বিশ্বাসী হবেন, প্রয়োজনে জাতির স্বার্থে যে কোন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনও করবেন, কিন্তু শিক্ষকতা, প্রকাশনা, গবেষণা ও সভা-সেমিনারই তাঁর প্রথম অগ্রাধিকার থাকবে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তাঁর শিক্ষকতা, গবেষণা, প্রকাশনা ও সভা-সেমিনারের বক্তব্যে শুধু বিবেকের দ্বারাই পরিচালিত হবেন, সত্য এবং শুধু সত্যেরই পুজারী হবেন, কোন রাজনৈতিক দলকে বা বিশেষ গোষ্ঠীকে তুষ্ট করা তাঁর জন্যে অবমাননাকর বিবেচিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কোন পদের জন্যে তদবির করা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে মানায় না, রাষ্ট্রের নীতি-প্রণেতারা যদি কোন শিক্ষকের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ও দক্ষতাকে অপরিহার্য মনে করেন তাহলে তাঁরা নিজেরাই ঐ শিক্ষককে অনুরোধ করে যথাযোগ্য পদে যোগ দিতে রাজি করাবেন।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাম্প্রতিক কালের উপাচার্যদের সবচেয়ে কঠিন অলিখিত দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দল বা ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদেন অন্যায্য খাই মেটানো। বিশ্ববিদ্যালয়ের তাবৎ নির্মাণ ঠিকাদারীর ওপর এখন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, এর আগে বিএনপি’র ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল। ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের খাই না মিটিয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন উপাচার্য ঠিকাদার নিয়োগ দিতে পারেন না, ঠিকাদাররাও এটা জানে। ছাত্রলীগের বা ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের সাথে বখরার মার্জিন নিয়ে ঠিকাদারদের কঠিন দরকষাকষির মীমাংসা হওয়ার পরই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে। স্বৈরাচারী এরশাদের সময় থেকে এই নিয়ম চালু হলেও নির্বাচনী গণতন্ত্রের মেয়াদে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিও এই অলিখিত নিয়ম মেনে চলছে গত ত্রিশ বছর ধরে। একই নিয়ম চালু হয়ে গেছে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও। এমনকি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এবং ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রেও ছাত্র সংগঠনগুলো ইদানীং নাক গলাতে শুরু করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। (অবশ্য শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এবং মূল রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের প্রভাব খাটানোটা বহুদিন আগেই নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে)। উপাচার্যদেরকে এভাবে ছাত্র সংগঠনগুলোর অন্যায় প্রভাবের কাছে জিম্মি করার ফল হিসেবেই আমরা কয়েক বছর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলামের চাঁদা প্রদানের দুঃখজনক ঘটনা ঘটতে দেখেছি। এহেন চাঁদাবাজির ঘটনা এখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অহরহ ঘটে চলেছে, পত্র-পত্রিকাগুলোও মাঝেমাঝে তা প্রকাশ করে চলেছে। এটা ওপেন সিক্রেট যে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই এখন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনকে খুশি করে গদি রক্ষা করে চলেছেন। এমনিতেই সার্বক্ষণিকভাবে ক্ষমতাসীন মহলের উচ্চ পর্যায়ের অন্যায় আবদার এবং লবিয়িং তাঁদের জীবনকে প্রবল টেনশনে ফেলে দিচ্ছে। এর সাথে ছাত্র সংগঠনের অন্যায় দাবি-দাওয়ার অহর্নিশ চাপ যুক্ত হয়ে এখনকার উপাচার্যদের দৈনন্দিন জীবনকে যে ঝালাপালা করে দিচ্ছে সেটা কি ওয়াকিবহাল মহলের অজানা? এই বাস্তবতার কারণেই সাম্প্রতিক কালে উপাচার্য হওয়াটা শিক্ষকদের অনেকের কাছে খুব সম্মানজনক, গৌরবজনক কিংবা লোভনীয় বিষয় বিবেচিত হচ্ছে না! অবশ্য, তদবিরবাজ শিক্ষকদের তুলনায় এই তদবির-বিমুখ শিক্ষকের সংখ্যা এখনো হয়তো অকিঞ্চিৎকর রয়ে গেছে!
এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্যে উপাচার্য হওয়ার জন্য তদবিরের সংস্কৃতি দূর করে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি ‘জাতীয় সার্চ কমিটি’ গঠন এখন সময়ের দাবি। (উপ-উপাচার্য পদ না থাকাই বাঞ্ছনীয় মনে করি)। আর, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত শিক্ষকদের মধ্য থেকে উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে কেন? আমার প্রস্তাব, দেশের কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্য থেকে সুপরিচিত পণ্ডিতদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাব্য উপাচার্যের একটি প্যানেল প্রস্তুতের দায়িত্ব একটি সার্চ কমিটিকে প্রদান করা যেতে পারে। যখন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদ খালি হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসবে তখন ঐ সার্চ কমিটিকে দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তিনজনের একটি উপাচার্য প্যানেল প্রস্তুত করে সেটা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে প্রেরণের। সার্চ কমিটিতে দেশের জাতীয় অধ্যাপকগণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যানগণ ও বর্তমান চেয়ারপার্সন দায়িত্ব পালন করতে পারেন। ছাত্র সংগঠনের নেতাদের এ ব্যাপারে তদবিরের কোন ভূমিকা পালনে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। একইসাথে, ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কবল থেকে উপাচার্যদের কার্যকর রক্ষাকবচের ব্যবস্থা চালু করার সৎসাহস দেখাতেই হবে। নয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার জন্য কোন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ও মর্যাদা-সচেতন পণ্ডিত ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুরূহ হবে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়