নগরবাসীর আবাসন নিশ্চিত করা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এই প্রতিষ্ঠানের বাধ্যতামূলক কাজগুলোর একটি এটি। তাই আমরা প্রত্যক্ষ করছি, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সিডিএ নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও এ দায়িত্ব পালন করে আসছে। গতকাল দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, ‘বায়েজিদ বোস্তামী আবাসিক এলাকা’ নামে নতুন একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। অনন্যা আবাসিক এলাকার মতো বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নের আশা বাদ দিয়ে সিডিএ ছোট ছোট আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বিশ একরের চেয়ে ছোট আয়তনের নতুন এই প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ‘সিডিএর নতুন আবাসিক প্রকল্প’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩৫৭ কোটি ৮২ লাখ ৫২ হাজার টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা আবাসিক এলাকাটিতে ৩ থেকে ৫ কাঠা আয়তনের ১৬৭টি আবাসিক এবং ১৮টি বাণিজ্যিক প্লট থাকছে। সিডিএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামসের বরাত দিয়ে বলা হয়, এই আবাসিক এলাকায় ভূমির দাম কাঠাপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা ধরা হবে। ফৌজদারহাট বায়েজিদ বোস্তামী লিংক রোডের পাশে ১৯.৬৫ একর জমির উপর নতুন এই আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রকল্পটিতে তিন কাঠার ১২৬টি, চার কাঠার ৭টি এবং পাঁচ কাঠার ৩৪টি আবাসিক প্লট থাকবে। এছাড়া ১৮টি বাণিজ্যিক প্লট এবং ৩৬.৫ কাঠার একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক এবং দুটি ইউটিলিটি ব্লক রাখা হয়েছে। প্রকল্পটিতে একটি কৃত্রিম হৃদ এবং সবুজের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোনো পাহাড় কাটতে হবে না। একটি টিলার সামান্য একটি অংশ প্রকল্পে ব্যবহার করা হবে। ইতোমধ্যে প্রকল্প এলাকাটি পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দেখিয়ে গ্রিন সিগন্যাল নেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৫৯ সাল থেকে সিডিএ গত ৬০ বছরে সর্বমোট বারোটি আবাসিক এলাকা বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকায় প্লটের সংখ্যা ৫৮টি, ১৯৬৫ সালে করা আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকায় প্লটের সংখ্যা ৩৯১টি, ১৯৭৩ সালে করা চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় প্লটের সংখ্যা ৭৫৯টি, ১৯৭৭ সালে করা কর্ণেল হাট সিডিএ আবাসিক এলাকায় প্লটের সংখ্যা ১৬৮টি, ১৯৮৪ সালে করা সলিমপুর সিডিএ আবাসিক এলাকায় প্লটের সংখ্যা ৯০৪টি, ১৯৯৫ সালে করা কর্ণফুলী আবাসিক প্রকল্পে প্লটের সংখ্যা ৫১৭টি, ২০০০ সালে করা চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকায় প্লটের সংখ্যা ১৮০টি, ২০০২ সালে করা চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা দ্বিতীয় পর্যায়ে প্লটের সংখ্যা ৮২টি, ২০০৬ সালে করা কল্পলোক আবাসিক এলাকায় প্রথম পর্যায়ে প্লটের সংখ্যা ৪২৩টি, ২০০৭ সালে করা কল্পলোক আবাসিক এলাকা দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৩৫৬টি, ২০০৮ সালে করা অনন্যা আবাসিক এলাকায় প্লটের সংখ্যা ১৪৭৮টি এবং ২০০৯ সালে ষোলশহর পুনর্বাসন এলাকায় সিডিএ ৪৮টি প্লট বরাদ্দ দেয় ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের। অর্থাৎ গত ৬০ বছরে সিডিএ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ১২টি আবাসিক এলাকায় ৬৩৬৪টি প্লট তৈরি করে বিভিন্নজনের নিকট বরাদ্দ দিয়েছে।
কিন্তু দুঃখের কথা হলো, নগরীর আবাসন সংকট ঘুচাতে সিডিএ প্লট বরাদ্দ দিলেও ১৯৮৪ সালের পর বরাদ্দকৃত দুই তৃতীয়াংশ প্লটেই কোনো বাড়িঘর নির্মিত হয়নি। একের পর এক প্লট হাতবদল হচ্ছে কেবল। মূল্য বৃদ্ধির অপেক্ষায় আছেন অনেকে। প্লট খালি থাকায় সিডিএ’র জনমুখী উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্যই এখনো অর্জিত হয়নি। এছাড়া, অপরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়ার ফলে সিডিএর সলিমপুর আবাসিক এলাকা এবং কর্ণফুলী আবাসিক এলাকা প্রায় পরিত্যক্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। প্লট বরাদ্দের পর একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাড়িঘর নির্মাণ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা পালন করার কোনো নজির ইতোমধ্যে দেখা যায়নি। প্লট বাতিলের আইনটি খাতায় আছে, তা কার্যকর করার উদ্যোগ কখনো দেখা যায় নি। এজন্য নগরীর আবাসন সংকট নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে বাস্তবমুখী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। প্লট বরাদ্দের পরিবর্তে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে নগরীর আবাসন সংকট ঘুচানোর উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আমরা প্রস্তাব রাখতে চাই। তাহলে অধিক সংখ্যক মানুষ এ সুযোগটা গ্রহণ করতে পারবেন। বিভিন্ন সাইজের ফ্ল্যাট করা হলে নানা শ্রেণির মানুষ আগ্রহী হবেন-তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব বিশ্বের সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবাসনের চাহিদাও বাড়ছে সে হারে। কিন্তু জমির স্বল্পতা রয়েছে। তারপরও আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো আবাসন-সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তারা সাধারণত জমির মালিকদের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ভবন নির্মাণ করতো। এত দিন ধরে এভাবেই চলে আসছে। এখন তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারও। সিটি করপোরেশন, বন্দর কর্তৃপক্ষ, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ভূমিকাও আছে এ ব্যাপারে। কেননা সরকারি পর্যায়ে আবাসন সংকট মোকাবেলায় কাজ করতে হয়। সিডিএ শুধু আবাসন সমস্যা নিরসন করে তা নয়, পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতেও কাজ করে। তারা যদি এক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করে, তাহলে অপরিকল্পিত নগরায়ণ থেকে শহরও রক্ষা পাবে। তাই আবারও প্লট বরাদ্দ দিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার সমূহ আশংকা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।