চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প গতি পেয়েছে। ফলে কর্ণফুলী নদীর গভীরতাও বাড়ছে বেশ। এক বছরেরও বেশি সময়ে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ ৩০ শতাংশের ধারে কাছে ঘুরলেও গত এক মাসেই অগ্রগতি পেয়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। এতে নদীর পানি ধারণক্ষমতাও বেশ বাড়ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নগরীর খালগুলো পরিষ্কার করা হলে জলাবদ্ধতা নিরসনে ভালো সুফল মিলবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় কর্ণফুলী নদী থেকে ৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বন্দর সূত্র জানিয়েছে, দেশের অর্থনীতির প্রাণ হিসেবে খ্যাত কর্ণফুলী নদী ক্রমে ভরাট হয়ে যাচ্ছিল। দীর্ঘদিন ধরে ক্যাপিটাল ড্রেজিং নিয়ে চলমান সংকট এই নদীর জন্য হুমকি হয়ে উঠছিল। এর মধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলী নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প গ্রহণ করলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এই প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছিল মালয়েশিয়ার মেরিটাইম এন্ড ড্রেজিং কর্পোরেশন নামের একটি কোম্পানিকে। তারা নিজেরাই স্থানীয় প্যাসিফিক মেরিন নামের অপর একটি কোম্পানিকে কাজে নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু এই দুই কোম্পানির লাগামহীন অনিয়মে প্রকল্পটি মাঠেই মারা পড়ে। আইনি জটিলতাসহ বিভিন্নভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ। একই সাথে বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়ে কর্ণফুলী। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ আইনি জটিলতা এড়িয়ে নদী থেকে ৪২ লাখ ঘনমিটার মাটি উত্তোলনের জন্য ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং’ নামের পৃথক একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ২৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন এই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হলেও কার্যতঃ এটি কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প। প্রকল্পটির আওতায় সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার চওড়া এলাকায় ড্রেজিং করার কথা। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর মাধ্যমে চীনা কোম্পানি ই-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পটির কাজ করছে। বেশ উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে প্রকল্পটির কাজ শুরু হলেও পলিথিন জঞ্জালে সব আয়োজন যেন ভুণ্ডুল হওয়ার উপক্রম হয়। কর্ণফুলীর তলদেশে ২০ ফুটের বেশি পলিথিন আস্তরের ফলে ড্রেজার দিয়ে মাটি ও বালি উত্তোলন ব্যাহত হয় মারাত্মকভাবে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
পরবর্তীতে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিম দিয়ে প্রকল্পটি নিয়ে নতুন করে হিসাব নিকাশ করা হয়। বিশেষজ্ঞ কমিটি নদী থেকে ৪২ লাখ ঘনমিটারের পরিবর্তে ৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালি উত্তোলনের সুপারিশ করে। ৯ লাখ ঘনমিটার বাড়তি মাটি ও বালি উত্তোলন করতে হলে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পায় ৬৩ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অনুমোদন সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০২ কোটি টাকা। নদীর তলদেশ থেকে সর্বমোট ৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালি উত্তোলন করার জন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে নতুন করে চুক্তি হচ্ছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরের কথা রয়েছে।
প্রকল্পটির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বুয়েটের বিটিআরসি ৫৮ শতাংশ মাটি ও বালি গ্রেভ দিয়ে উত্তোলনের পরামর্শ দেয়। একই সাথে এই কাজে বিদেশ থেকে গ্রেভ না এনে দেশিয় গ্রেভ দিয়ে মাটি উত্তোলনের কথা বলা হয়। ৪২ শতাংশ মাটি নরমাল কাটার দিয়ে কাটার পরামর্শ দেয়া হয়।
নতুন প্রস্তাবনায় গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কর্ণফুলী নদীতে নতুন উদ্যোমে কাজ চলছে। বর্তমানে রাজাখালী খালের মুখ বরাবর কাজ চলছে উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ আরিফ গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, কর্ণফুলী ব্রিজের পিলার এবং পাইলিং এরিয়ায় খুবই সতর্কতার সাথে কাজ করতে হবে। তাই ব্রিজের দু’দিকেই দুইশ’ মিটার করে জায়গায় আপাতত আমরা কোনো কাজ করছি না। পরবর্তীতে সতর্কতার সাথে ওই এলাকা থেকে মাটি তোলা হবে।
তিনি কাজ এবং ব্যয় বাড়ার সাথে সাথে প্রকল্পের মেয়াদও এক বছর বাড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, আশা করছি আগামী ছয় মাসের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। গত এক বছরেরও বেশি সময় আমরা নানাভাবে সীমাবদ্ধতা মোকাবেলা করলেও এখন কাজের গতি বেশ সন্তোষজনক। গত এক মাসে ১১ শতাংশ কাজ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই গতিতে আমরা ছয়মাসের মধ্যেই নদী থেকে ৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালি উত্তোলন করতে সক্ষম হব। নদী থেকে বিপুল পরিমাণ মাটি ও বালি উত্তোলনের ফলে কর্ণফুলী নদীর গভীরতা বেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে নদীর নাব্যতা এবং পানির ধারণক্ষমতা বাড়ছে।
এদিকে জলাবদ্ধতা নিরসনে নগরে চলমান মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ শাহ আলী আজাদীকে বলেন, কর্ণফুলী ড্রেজিংয়ের সুফল অবশ্যই পাওয়া যাবে। কারণ, তলা পাকা করার কারণে কিছু কিছু খালের গভীরতা আগে থেকে নির্দিষ্ট করা করা আছে। খালগুলোর যে লেবেল তা নদীর চেয়ে নিচু হয়ে আছে। নদী ভরাটের কারণে নদীর তলার লেবেল ‘আপ’ হয়ে গেছে। অর্থাৎ ভরাট হতে হতে নদীর গভীরতা কমে গিয়ে নদীতে পতিত খালগুলোর মুখ নদীর চেয়ে নিচু হয়ে গেছে। এতে আমরা খালের পুরো কাজ করলেও কিছু পানি খালে সবসময় থেকে যাবে। পুরো পানি যেতে পারবে না। তাই কর্ণফুলীর খননটা জরুরি ছিল। খনন হওয়ার ফলে নদীর তলদেশ নিচে নেমে যাবে। এতে শহরের যে পানি তা নিষ্কাশনে সহজ হবে। তিনি বলেন, বন্দরের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন সময়ে যে আলোচনা হয়েছে সেখানে খালের পয়েন্টগুলো দিয়েছি। এখন তারা যে খনন করছে তা অবশ্যই উপকার হবে।