আমরা কি করোনার তৃতীয় ঢেউ এবং ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের কবলে পড়তে যাচ্ছি?
ঈদের শুভেচ্ছা জানাই আমার পাঠক, পাঠিকা, ছাত্র-ছাত্রী এবং সাবেক সহকর্মীদের। আমি আমার সকল শুভাকাঙ্ক্ষীর সুস্বাস্থ্য ও সুন্দর ভবিষ্যত কামনা করি। অসুস্থতার কারণে অনেকদিন লিখতে পারিনি। সম্প্রতি লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকে আমাকে লেখার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু আমি সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত নই যে আমি লেখা চালিয়ে যেতে পারবো কি-না? গত বুধবার একটি দুঃখজনক সংবাদ পেয়েছি, ড. অনুপম সেনের স্ত্রী পরলোকগমন করেছেন। আমি উনার আত্মার শান্তি কামনা করি। ড. অনুপম সেন আমাদের খুবই প্রিয়। অনুপম সেনের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবন কামনা করি।
দেশে এখন করোনার প্রকোপ কিছুটা কমে এসেছে। সরকার লকডাউন, বিধি নিষেধ জারি করে মানুষকে ঘরে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মহাসড়কে বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল, ফেরিতে হাজার মানুষের নদী পারাপারের দৃশ্য, শপিং মলে নারী শিশুসহ সকল প্রকার মানুষের জনসমুদ্র দেখে রোগতত্ত্ববিদগণ ভবিষ্যতবাণী করেছেন যে মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে করোনার তৃতীয় ঢেউ বাংলাদেশে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসতে পারে। ভারতের পশ্চিমবাংলায় সংক্রমণের মাত্রা কমে এসেছিলো। কিন্তু তাদের নির্বাচনে ব্যাপক জনসমাগম ঘটার পর এখন পশ্চিমবাংলার গ্রামে গ্রামে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে। মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে গেছে। ওষুধপত্র, অঙিজেনের জন্য, আইসিইউ এর জন্য মানুষ ছোটাছুটি করছে। অনেকেই ফেসবুক লাইভে এসে সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করছে। দিল্লী ও মহারাষ্ট্র থেকে পূর্বদিকের রাজ্য উড়িষ্যা, পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরাসহ অন্যান্য রাজ্যগুলিতে করোনার বিপর্যয় শুরু হয়েছে। এ রাজ্যগুলি বাংলাদেশকে উত্তর পশ্চিম ও পূর্বদিকে ঘিরে রেখেছে। এই বিশাল সীমান্ত সিল করে দেওয়া সম্ভব নয়। তার উপর যশোরে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এর করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। ভারতের বিহার রাজ্য এবং উত্তর প্রদেশের পাশ দিয়ে প্রবাহিত যমুনা ও গঙ্গা নদীতে একসাথে অনেক মৃতদেহ ভেসে আসতে দেখা গেছে। গঙ্গা নদীতে একসাথে ৪৫ থেকে ৫০টি মৃতদেহ ভাসতে দেখে পুলিশ সেগুলি উদ্ধার করেছে। এই কারণে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। ভারতীয় পুলিশের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নদীতীরবর্তী গ্রামগুলিতে করোনার আক্রমইে এতো মানুষ মারা যাচ্ছে যে গ্রামবাসীদের পক্ষে মৃতদের সৎকার করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই তারা তাদের পিতা-মাতা, ভাইয়ের মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ভারতের ভাইরাসগুলি রূপ পরিবর্তন করে অনেক শক্তিশালী রূপ ধারণ করেছে। তার মধ্যে ভারতের নির্বাচন, কৃষক আন্দোলন, কুম্ভ মেলার মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পর্যটন কেন্দ্রে লোকের আনাগোনা এসব কিছুর কারণে ভারত করোনা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। আমরা ভারতের এই দুর্দশা দেখেও শিক্ষা নিচ্ছি না।
আমাকে একজন উচ্চশিক্ষিত কর্মকর্তা ফোন করেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন করোনার আক্রমই প্রতিরোধের জন্য আপনি কি কোন ওষুধপত্র খাচ্ছেন? আমি বলেছিলাম, কি ওষুধপত্র খেতে হবে তা আমি জানি না। উনি বলেছিলেন লেবুপাতা পিষে রস নিবেন, তুলশী পাতার রস নিবেন, সাজনা পাতা সিদ্ধ করে পানি নিবেন। দূর্বা ঘাসের আগা পিষবেন, সব রস একত্রিত করে মধুর সাথে মিশিয়ে দিনে দুইবার খাবেন। পানির সাথে ১% বায়োডিন মিশিয়ে কুলি করবেন। দেখবেন, এরকম যারা করে তাদের করোনা হতেই পারে না। এটা করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময়ের ঘটনা। করোনা প্রতিরোধের জন্য এরকম অনেক টোটকা ওষুধের প্রেসক্রিপশন অনেকেই আমাকে দিয়েছেন। আমাদের দেশে জন্ডিস রোগ হলে হাতুড়ে ডাক্তারেরা সারা শরীরে চুনা এবং কাদামাটি মেখে পুকুরে গোসল করায়। এতে নাকি জন্ডিস ভালো হয়। গণমাধ্যমে ভারতের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের সংবাদ শুনে আমি বিস্মিত হয়েছি। করোনা প্রতিরোধের জন্য ভারতের ঐ অঞ্চলের শিক্ষিত অশিক্ষিত, পুরুষ নারী, অধিকাংশ লোক নাকি গোমূত্র, গোবর, মাখন, দুধ, দই একসাথে মেখে তা শরীরে লেপ্টে দেয়। এ মিশ্রণ শুকানোর জন্য রোদে বসে থাকে। শুকানোর পর তারা গোসল করে। এটা নাকি করোনা প্রতিরোধের শ্রেষ্ঠ উপায়। ভারতীয় গবেষকরা বলেছেন এটি একটি অবৈজ্ঞানিক পন্থা। এতে করোনা প্রতিরোধ তো হবেনা, বরং অন্যান্য সংক্রামক রোগ বেড়ে যাবে। আমি ভারতের কেরালা, তামিলনারু, তেলেঙ্গানা-হায়দ্রাবাদ, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবাংলা, উরিষ্যা, কর্ণাটক, দিল্লিসহ অনেক রাজ্যে গিয়েছি, তাদের জনগণের চিন্তা ভাবনার স্তর অনেক উঁচু বলে আমার মনে হয়েছে। তারপরেও বাংলাদেশ বা ভারতে এইসব কুসংস্কার মানুষকে গ্রাস করছে। এটা করোনা বিপর্যয় ঠেকানোর পথে বিরাট বাধা।
গণমাধ্যম থেকে আমরা এবং আপনারা সবাই জানতে পারছি যে করোনা মহামারীর পিছনে পিছনে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ধেয়ে আসছে। এই ফাঙ্গাসের আক্রমণে করোনা বেঁচে যাওয়া মানুষগুলি হয় অন্ধ হয়ে যাবে নাহয় মস্তিষ্ক বিকল হয়ে মারা যাবে। এই ফাঙ্গাস রোগ প্রতিরোধহীন মানুষকে সহজে আক্রমণ করে। এটা মানুষের কপাল এবং নাকের বিপরীতে সাইনাস এবং মগজ আক্রমণ করে। আক্রান্তকে বাঁচাতে হলে অপারেশন করে তার চোখ উঠিয়ে ফেলতে হবে। এতো ভয়াবহ এই ফাঙ্গাস। এই ফাঙ্গাস মানুষের মস্তিষ্ককে কালো বর্জ্যে রূপান্তরিত করে এবং তা নাক দিয়ে বেরিয়ে আসে। ভারতে করোনা থেকে রক্ষা পাওয়া অনেক লোক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়েছে। আইসিইউতে যখন করোনা রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়, তখন চিকিৎসকগণ স্টেরয়েড ব্যবহার করেন। এতে রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। আইসিইউ ফেরত রোগীরা বেঁচে থাকলে তাদের ফাঙ্গাস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশে এই ফাঙ্গাস কি আছে? এ প্রশ্নের উত্তর হলো বাংলাদেশে এই ফাঙ্গাস আছে। মাটিতে, বাতাসে ভেসে বেড়ানো ধুলা বালিতে এই ফাঙ্গাস ঘুরে বেড়ায়। তবে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে তাদের জন্য এটা কোন ভয়ের কারণ নয়। কিন্তু করোনার কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় তাদের জন্য এটা বিপদের কারণ হতে পারে। আমরা আন্দাজ করছি যে আমাদের দেশে গত এক সপ্তাহে হাটে, বাজারে, শপিংমলে, নদী পারাপারের ফেরিতে, মহাসড়কের যানবাহনে যেভাবে লোক সমাগম হয়েছে তাতে দুই সপ্তাহের মধ্যে করোনার তৃতীয় ঢেউ দেখা দিতে পারে। কিন্তু আমরা অনুমান করতে পারছি না এই তৃতীয় ঢেউয়ের বিপর্যয় কতো ভয়াবহ হতে পারে। যদি আমরা বুঝতাম, তাহলে সকল রকম স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে আমরা এতো বেপরোয়াভাবে ঘোরাঘুরি করতাম না। লকডাউন দেওয়ার জন্য সরকারকে দোষারোপ করতাম না।
লকডাউনের বিরোধী একজন প্রবীণ মানুষ আমাকে ফোনে বললেন করোনা রোগ ঠেকানোর সহজতম একটি উপায় আছে। আপনি কি সেটি জানেন? আমি বললাম, সেটি আমি জানি না। তিনি বললেন, আমি প্রবীণ মানুষ, আমার কথাটার দাম দিবেন। বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষকে ঘরে ঢুকে যেতে হবে। যদি ঘর থেকে বেরুতে চায়, তাহলে তাকে তার বাড়ির সীমানার ভিতরে থাকতে হবে। কোন অবস্থাতে বাড়ির সীমানার বাহিরে শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউ যেতে পারবে না। রাস্তাঘাট সব খালি থাকবে। এই অবস্থায় দেশকে যদি বিশদিন ধরে রাখতে পারেন তাহলে করোনা বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এটি করোনা নিয়ন্ত্রণের সহজ উপায়।
আমি তাকে বললাম, এরকম করলে তারা খাবার দাবার কোথায় পাবে। তাকে তো ওষুধের জন্য, খাদ্যদ্রব্যের জন্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য বাড়ির বাহিরে দোকানে বা বাজারে যেতে হবে। দোকানপাঠ, কাঁচাবাজার, ফার্মেসী, হাসপাতাল, ডাক্তারখানা, জরুরি সার্ভিস, আইনশৃংখলা বাহিনী, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ এগুলিতো খোলা রাখতে হবে। সে হাসতে হাসতে বললো আমি এজন্যই লকডাউনের ঘোর বিরোধী। লকডাউন করে সবকিছু বন্ধ রেখে করোনা নিয়ন্ত্রণের স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হবে না। মানুষ কিছুতেই ঘরে থাকবে না। এই অবস্থায় শুধু বাংলাদেশ নয় সারাবিশ্ব থেকে কিভাবে করোনা দূর হবে সেটা ভেবে বের করা খুবই কঠিন।
আমাদের দেশে ওয়ান পার্টি রুল নেই যে সরকার জোর করে মানুষের উপরে কোন নির্দেশ চাপিয়ে দিতে পারবে। আমরা রাজনীতির খেলা এবং রাজনৈতিক কূটকৌশলের চক্করের মধ্যে ঘুরপাক খাই। চীন, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার এইসব দেশের মডেল অনুসরণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলি একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে। এটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ। কিন্তু এখন আমরা করোনাভাইরাস, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। আমাদের দেশের ষোল কোটি মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ প্রজন্মকে বাঁচাতে হবে। আমাদের চিকিৎসকদের সুরক্ষা দিতে হবে। এই যুদ্ধে আমাদের একক শত্রু হচ্ছে ভাইরাস। তাকে অস্ত্র, গোলাবারুদ দিয়ে ঠেকানো যাবে না। তার বিরুদ্ধে কোন প্রযুক্তিও কার্যকর হবে না। তাকে ঠেকানোর একমাত্র উপায় হলো সকল মানুষ যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে এবং সকল মানুষকে যেন টিকা প্রদান করে রোগ প্রতিরোধী করা যায়। করোনার বিরুদ্ধে সকল রাজনীতিবিদ, সকল রাজনৈতিক দল, সকল জনপ্রতিনিধি, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। যুদ্ধে না জেতা পর্যন্ত সব ভেদাভেদ ভুলে যেতে হবে। করোনার কাছে কে মন্ত্রী, কে সাবেক মন্ত্রী, কে আমলা, কে শিল্পপতি, তার কোন পরিচয় নাই। সে মানুষ পেলেই তার ফুসফুসের ভিতরে ঢুকে যায়। শুধুমাত্র মানুষকে মারার জন্য সে তার রূপ ও ধরণ পরিবর্তন করে। এই ফাঙ্গাস এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশকে মানুষের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। মানুষের বোধশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। টিকা রাজনীতিতে বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখতে হবে। এই যুদ্ধে কারো অদক্ষতাকে ক্ষমার চোখে দেখার কোন সুযোগ নাই।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট।