আরবে উভয় পবিত্র নগরীর সাথে এ উপমহাদেশির হৃদয়ের সম্পর্ক
নবী পাক (স.) কর্তৃক পবিত্র মক্কায় ইসলামের সূচনা, পবিত্র মদিনায় ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা। পরবর্তীতে বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষ পর্যায়ক্রমে ইসলামের আলোতে আলোকিত হয়। তার অন্যতম কারণ আরবীয়গণের দূরযাত্রায় সাগরপথ ব্যবহার। অবশ্য ভারতবর্ষের পশ্চিমাঞ্চলে ইসলামের প্রাথমিক যুগে মহান সাহাবাগণ কর্তৃক ইসলামের প্রচার হয় বলে জানা যায়। ভারতের ত্রিবান্দ্ররাম থেকে কন্যাকুমারী যেতে সাহাবা আমলের মসজিদ ও সংলগ্ন কবর রয়েছে। চেন্নাই (মাদ্রাজ) থেকে ২০/৩০ কি.মি দক্ষিণে সাগরপাড়ে মহান সাহাবা তামীম আনসারী (র.)’র মাজার রয়েছে। চীনের গুয়াংজুতে শায়িত মহান সাহাবা হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (র.) চট্টগ্রাম হয়ে গমন করেন বলে জানা যায়। ওমাইয়া শাসন আমলে ভারতবর্ষের পশ্চিমাঞ্চলে সিন্ধুতে পর্যন্ত ইসলামের আগমন হয়। আব্বাসীয় আমল হতে ভারতবর্ষের সাথে পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনার অত্যধিক সম্পর্কের বর্ণনা পাওয়া যায়। অর্থাৎ এ উপমহাদেশের মুসলমানগণ মক্কা মোকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারার প্রতি যেমনি অত্যধিক শ্রদ্ধাভক্তি রাখতেন, তেমনি আব্বাসীয় খলিফাগণের প্রতিও ভক্তি ও শ্রদ্ধাশীল থাকতেন। ভারতবর্ষবাসী বাগদাদ, আব্বাসীয় খলিফার প্রতিনিধি পরবর্তী ওসমানী, তুর্কি সুলতানগণকে ইসলামের সাহায্য ও দুই হারমের সাহায্যকারী বলে গণ্য করতেন। বাগদাদের খলিফা সুলতান মাহমুদ গজনবীকে সাম্রাজ্য ও ইসলামের শাসনস্থল উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুলতানগণের নিয়োগপত্র এবং মূল্যবান খেলাফত নামা বাগদাদ থেকেই আসত। এ উপলক্ষে শহরে উৎসব পালিত হত।
খলজি, তুঘলকি ও লোদী বংশসমূহের সুলতানগণ কর্তৃক প্রর্বতিত মুদ্রায় এ উপমহাদেশীয় সুলতানগণের নামের সহিত আব্বাসীয় খলিফাগণের নামও মুদ্রিত থাকত। এ উপমহাদেশের সুলতানের প্রতিনিধি হয়ে বাগদাদে খলিফাগণের নিকটে প্রেরিত হতেন। শুধু তাই নয়, ভারতবর্ষের সুলতান এবং তাদের প্রাদেশিক শাসনকর্তা খলিফাগণ নিয়ন্ত্রিত মক্কা মোকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারা খেদমত করাকে নিজেদের সৌভাগ্য মনে করত।
বাংলার শাসনকর্তা সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ (১৩৯০-১৪১০) স্বীয় প্রধানমন্ত্রী জাহান খানকে মক্কা মোকাররমায় প্রেরণ করেন। তাকে দিয়ে তথায় মুসাফিরখানা ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করিয়ে ছিলেন। শুধু তাই নয়, মক্কা মোকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারা বাসিন্দাগণকে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করেন।
সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সাগরপথে হজ্বযাত্রী প্রেরণের ব্যবস্থা করছিলেন। এ সময় বাংলার দুই বিখ্যাত শহর ঢাকা ও কলকাতার অস্তিত্ব ছিল না। ঢাকা প্রতিষ্ঠা লাভ করে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে। অপরদিকে কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠা লাভ করে পলাশি যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলা পরাজয়ের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক। বিহারের বিখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্ব হযরত মোজাফ্ফর শাহ বলখি সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহর নিকট চিঠি লিখেন, যেন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে হাজীদের প্রথম জাহাজে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত দিল্লির তিন বংশীয় সুলতানগণের সাথে বাগদাদের খলিফা এবং সাথে সাথে পবিত্র দুই নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু ছিল। সেই সময় উত্তর ভারতের অধিকাংশ হাজী স্থলপথে আফগানিস্তান, ইরান ও ইরাক হয়ে হেজাজে গমন করতেন। কিন্তু ঐ দিকে নিরাপত্তার অভাব ও রাস্তা বিপদ সংকুল হওয়ায় সুরাট বন্দর দিয়ে সাগরপথে হেজাজে গমন করত ইয়ালামলাম বা জেদ্দা বন্দর দিয়ে।
মুঘল আমল: মুঘল প্রথম সম্রাট বাবর দিল্লির সিংহাসনে আরোহণের পর উভয় হারম শরীফে হাদিয়া উপহার সামগ্রী প্রদান করছিলেন। তিনি সহস্তে লিখিত একখানা কুরআন মাজীদ মক্কা মোকাররমায় হাদিয়া হিসেবে প্রেরণ করেন।
শেরশাহ সুরীর আকাঙ্ক্ষা ছিল তিনি কোন একটি পবিত্র নগরীর খাদেম হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবেন। শুধু তাই নয়, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাকের দিকে যুদ্ধ করে হজ্বের যাতায়াতপথ নিরাপদ করবেন। যেহেতু সে সময় সাগরপথের চেয়ে স্থলপথই উত্তম ছিল। কিন্তু মৃত্যু তাকে সেই সুযোগ দেয় নাই।
সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) আমলে প্রথম দিকে হজ্বযাত্রী রওনা হতে এহরাম বেঁধে তাকবীর বলতে বলতে খালি পায়ে উন্মুক্ত মাথায় অনেকে সম্মান দেখায়ে হাজীগণের সাথে অনেক দূর গমন করতেন। সম্রাট শাহ জাহান (১৬২৮-১৬৫৮) আমলে একবার পবিত্র মক্কা মোকাররমায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ সংবাদ সম্রাট অবগত হলে তিনি সুরাট বন্দর দিয়ে কয়েক লক্ষ টাকার সাহায্য সামগ্রী তথায় প্রেরণ করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব (১৬৬৮-১৭৬০) আমলে আগেকার রীতিমতে উপমহাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ এবং ওলামা এর মাধ্যমে উভয় হারম শরীফের সাহায্যার্থে অর্থ প্রেরণ করতেন। অর্থাৎ মুঘল বাদশাহগণের রীতি ছিল হাজীগণের একজন আমির নিযুক্ত করা। তাঁর মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা উভয় পবিত্র নগরীতে খেদমতের নিয়তে পাঠিয়ে দিতেন। এ অর্থ সাধারণত গুজরাটের আহমদাবাদ ধন ভাণ্ডার থেকে পাঠানো হত। বাদশাহ শাহ জাহান খুশবুদার দ্রব্য সামগ্রী প্রেরণ করতেন। সেই সময় মূলতানের শাহী কারখানায় মসজিদে নববীর দৈর্ঘ্য প্রস্থ বরাবর একটি গালিচা তৈরি করে পাঠান।
ব্রিটিশ আমল: হায়দারাবাদ, ভূপালসহ বিভিন্ন অঞ্চলের নবাবগণ দুই পবিত্র নগরীতে বাৎসরিক ভিত্তিতে উপহার সামগ্রী পাঠাতেন। নবাব সিদ্দিক হাসান খান ও ভূপালের শাসক শাহজাহান বেগম হজ্ব পালন উপলক্ষে আরবভূমিতে গমন করেন। তিনি উভয় পবিত্র নগরীতে উদার হস্তে এত বেশি অর্থ সম্পদ ব্যয় করছিলেন যে, এ আলোচনা বহুকাল ধরে জাগরুক ছিল। কুমিল্লা (লাকসাম) নবাব ফয়জুন্নেছা হজ্ব করতে যাওয়ার সময় প্রচুর অর্থ কড়ি নিয়ে যান। তিনি দীর্ঘ সময় থাকেন হজ্ব উপলক্ষে।
সুলতান সম্রাট নবাবগণ বাদেও বাংলাসহ ভারতবর্ষের সম্পদশালীরা উভয় পবিত্র নগরীতে অর্থ সম্পদ প্রেরণ করতেন।
তুর্কি সুলতানগণ ১৮ ‘শ’ শতকের দিকে এসে রাজনৈতিক, আর্থিক আগেকার জৌলস হারিয়ে ফেলে। দামেস্ক থেকে ১৪৪৬ কি.মি পর্যন্ত মদিনা মুনাওয়ারা রেলপথ নির্মাণ করতে আর্থিক সংকটে পরে। সেই সময় ভারতবাসী অর্থ, স্বর্ণ প্রেরণ করছিল।
ভারতীয় উপমহাদেশ কেবল উভয় পবিত্র নগরীতে আর্থিক সহযোগিতা করে ক্ষান্ত হননি। এখানে বসে এলম প্রচারে সময় ব্যয় করেন। তৎমধ্যে অন্যতম হল হযরত আবুল বাশার নাজী সারহিন্দী, হযরত শেখ আবুল হায়াত সারহিন্দী, হযরত শাহ আবদুল মজিদ মুজাদ্দেদী। উক্ত মহান ব্যক্তিগণ বাদেও উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেমগণ উভয় পবিত্র নগরীতে বসে পাঠ দান করতেন। আগামীবারে সমাপ্ত।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট