দেশে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ২২৭ ডলার। সোমবার পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে এই তথ্য জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা সচিবালয় থেকে বৈঠকে যুক্ত ছিলেন। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার। এর আগে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৬৪ দলার। ৯ শতাংশ হারে মাথাপিছু আয় বেড়েছে। প্রাথমিক তথ্য বলছে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার এখন ৩০ লাখ ৮৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যেটা আগের অর্থবছরে ছিল ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা।
একটি ক্রমবর্ধনশীল এবং ঘন জনসংখ্যার দেশে এ রকম সাফল্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সাফল্যের পেছনের কারণ রয়েছে অনেক। বিগত দশকগুলোতে পশ্চাৎপদ কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ ক্রমেই শিল্প এবং সেবা খাতনির্ভর উন্নয়ন কৌশলের দিকে ধাবিত হয়েছে। ফলে শতাব্দী ধরে চলা কৃষি খাতের উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি স্থানান্তরিত হয়েছে শিল্প এবং অন্যান্য অসংগঠিত খাতে, যা এই অদক্ষ অথচ ছদ্ম বেকার জনশক্তির আয় বৃদ্ধি করেছে। অন্যদিকে কৃষি খাতে প্রযুক্তি এবং অন্যান্য উন্নত পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন বেড়েছে কৃষি উৎপাদনের হার, অন্যদিকে অর্থকরী ফসলমুখী প্রবণতা কৃষি খাতকে প্রান্তিক আয়ের উৎসে আটকে রাখেনি, কৃষিব্যবস্থাকে করেছে মুনাফানির্ভর। এই উভয়মুখী প্রক্রিয়া দারিদ্র্য নিরসন এবং আয় বৃদ্ধির একটা প্রধান নিয়ামক।
ইতোপূর্বে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিঙ এন্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে পূর্বাভাস দিয়েছে যে, বাংলাদেশ এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। এই রিপোর্ট অনুযায়ী আর মাত্র ৭ বছর পর পরেই চীন হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০৩০ সালে ভারত হবে তৃতীয়। আর ২০৩৫ সাল নাগাদ ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বহু ধাপ উপরে উঠে পৌঁছে যাবে ২৫ নম্বরে। সিইবিআর বলছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনেক ওলট-পালট ঘটে গেছে। ইউরোপ-আমেরিকার বেশিরভাগ বড় অর্থনীতির দেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর বিপরীতে চীন খুব কৌশলে করোনাভাইরাস দ্রুত এবং কঠোরভাবে মোকাবেলার কারণে সামনের বছরগুলোতে পৌঁছে যাবে বেশ সুবিধেজনক অবস্থানে। চীন যে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে, সেটাকে সময়ের ব্যাপার বলেই মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু সিইবিআর বলছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এই প্রক্রিয়া আরও দ্রুততর হয়েছে। আগে যা ধারণা করা হয়েছিল, তার থেকে ৫ বছর আগেই ২০২৮ সালে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। চীনের মতোই একইভাবে বাংলাদেশও যেহেতু করোনাভাইরাসের মধ্যেও কিছুটা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছে, তাই সামনের বছরগুলোতে বাংলাদেশে ধারাবাহিক এবং জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আশা করছি সিইবিআর। সিইবিআর তাদের রিপোর্টে বলছে, কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর আগের বছরগুলোতে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল বেশ ভালো এবং এটা ঘটেছে দেশটিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও। গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়ছে গড়ে ১ শতাংশ হারে।
কিন্তু অর্থনীতি বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, কেবল আয় বৃদ্ধিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে গিয়ে যেন অন্যান্য দিক উপেক্ষা করা না হয়। তাহলে উন্নয়নের সব সহযোগী নিয়ামক নিশ্চিত করার মতো সক্ষমতা থাকবে না। এ ছাড়া উচ্চ মাথাপিছু আয়ের জোয়ারে শ্রমের মূল্য বেড়ে গেলে নিম্ন মধ্যম ও মধ্যম আয়ের দেশ রপ্তানির প্রতিযোগিতামূলক বাজার হারাতে থাকে। অন্যদিকে শিল্পজাত পণ্য উৎপাদনেও উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পেরে ওঠে না এসব দেশ। ফলে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং নিম্ন প্রবৃদ্ধির কারণে মধ্য কিংবা নিম্ন মধ্যম আয়ের চক্কর থেকে বের হতে পারে না দেশগুলো। লাতিন আমেরিকার মেঙিকো বা ব্রাজিল কিংবা ইন্দোনেশিয়া বা থাইল্যান্ড এই চক্করে পড়ে আছে এখনো। তাই অর্থনীতির চালিকাশক্তি নবায়নের জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি, উন্নততর প্রযুক্তি এবং যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগত ভিত্তি।