মহামারির মধ্যে এক চরম অনিশ্চয়তা নিয়ে এসেছে মুসলিম সমপ্রদায়ের বড়ো উৎসব ঈদুল ফিতর। এক বন্ধুর সময় পার করছি আমরা। করোনার সাথে যুক্ত হয়েছে সমাজ ও রাজনীতিতে ভাঙন, বিভেদ -অসামপ্রদায়িক আচরণ, নারীর প্রতি অসম্মান, শ্রমিকদের প্রতি বঞ্চনা। মনে হয় এই সংকটকালেও আমরা আশাবাদী হতে পারছি না বরং এক এবড়ো খেবড়ো পথে এলো ঈদ তথা মানুষে মানুষে মিলনের উৎসব।
নগরায়ন এবং শিল্পের প্রসারের ফলে গ্রামীণ কাঠামোতে চিড় ধরায় দলে দলে মানুষের শহরে আসা। কিন্তু এ শহরে তারা ছিন্নমূল। ফলে ঈদের ছুটিতে প্রাণের টানে গ্রামে যেভাবেই হোক। ঈদে বাড়ি যাওয়া এই সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী মানুষ মানছে না লকডাউন। দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধেও মানুষের ঢল। কী অবর্ণনীয় কষ্টে ছুটছে। এর সাথে কিন্তু করোনাও যাচ্ছে।এবারে গ্রামের মানুষের মাঝে যদি করোনা ছড়ায় তবে শত শত লোকের সংকট হবে অঙিজেনের।
ঈদের কেনাকাটা করতেই হবে! আত্মীয় স্বজনরা আসুক বা না আসুক। কোথাও যেতে পারি বা না পারি। ভোগবাদী সমাজের আগ্রাসনের কবলে আমরা অনেকেই। জীবিকা ও জীবনের লড়াইয়ে কতো মানুষের পেশাবদল। কতো মানুষের চরম দারিদ্র্য। এক নীরব ক্ষুরধার মহামারির দিকে আমাদের জনগণের একাংশ। কিন্তু আমরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। এক বা দুই নয় দরকার অনেক। এই নিষ্ঠুর আনন্দের আয়োজনে পরিবার দায়ী। আমাদের শৈশবে আগে গরীব আত্মীয় স্বজনদের জন্য কেনাকাটা আগে অতঃপর নিজেদের। এতে মানবতার শিক্ষা মনের ভেতরে প্রোথিত হতো। কিন্তু এখন সন্তানেরা দেখছে বা উপলব্ধি করছে বাবাতো আনছেই। যেভাবে হোক। অতঃপর ‘যেভাবে হোক’ এই অপসংস্কৃতিতে ঢুকে যাচ্ছে সন্তানেরাও। আর যাদের অভিভাবক দিতে পারছে না তাদের অনেকে আত্মহত্যা করছে। ঈদে রমরমা চাঁদাবাজ ব্যবসা। তাদের জন্য সুখময় মাস। ফুটপাতের ব্যবসা থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মার্কেটেও। এদের কাছে ঈদ আসে অন্যভাবে। আর এতে যোগ দেয় গডফাদার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ কেউ।
করোনার তৃতীয় ঢেউ আসার আশঙ্কা করছেন অনেকে। কারণ মানুষ একেবারে বেপরোয়া আচরণ। মৃত্যু সামনে, আকাশে বাতাসে নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। কতো কতোজনের আর্তনাদ। প্রিয়জন হারানোর বেদনা। আর সব ভুলে আমরা অনেকে এতো নির্বিকার। কেন! কোথায় গলদ! আমরা হয়তো এখনো পুরোপুরি মানুষ হয়ে উঠিনি। এটি এক নির্মোহ পর্যবেক্ষণ। জাতি গঠনের উপাদান তথা শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সামাজিক আচরণ এগুলোতে আমরা এখনো দুর্বল। এর সাথে যুক্ত প্রদর্শনের মোহ। ঈদের মূল যে বাণী সবাইকে নিয়ে আনন্দ তা থেকে দূরে অনেকে। সুতরাং লকডাউন বা সীমিত আকারে দোকান থেকে বাজার! সবই মিছে। রাত দুপুর পর্যন্ত ভিড় আর ভিড়। কেন! আমরা আলিঙ্গন করতে পারবো না, মুখোশ পরে থাকবো তবুও কিনতেই হবে।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ও জনগণের সাথে রাষ্ট্রের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধে অবস্থার বিপরীত চিত্র।
পরিশেষে বলি আনন্দটা আপেক্ষিক ব্যাপার। উপভোগের নানা ধরন থাকলেও আত্মতুষ্টির বা আত্মতৃপ্তির থেকে যে মূল্যবোধ সৃষ্টি হয় তা শেখার জন্য দরকার সুষ্ঠু পারিবারিক শিক্ষা। তা আমরা কয়জন দিচ্ছি!
এর পরেও ঈদের আনন্দ আয়োজনের পরে যেন কোন ধরনের বিপর্যয় না ঘটে তাই কায়মনোবাক্যে প্রত্যাশা করি।
লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ