করোনাকালীন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক থ্যালাসেমিয়া দিবস

ডা: মাহমুদ আহমেদ চৌধুরী আরজু | শুক্রবার , ৭ মে, ২০২১ at ৫:৩২ পূর্বাহ্ণ

আগামীকাল ৮ই মে। আন্তর্জাতিক থ্যালাসেমিয়া দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘সারাবিশ্বের থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার অর্জনে বাধা দূরীকরণ’। এই প্রতিপাদ্য বিষয়ের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বিশ্বের সমস্ত রোগীদের নানাবিধ চাহিদা, তাদের চিকিৎসা ও একজন সুষ্ঠু মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকারকে নিশ্চিত করে। বস্তুত পক্ষে এই দিবসটি একটি সচেতনতা দিবস। থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধ ও রোগের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই এই দিবসের মূল লক্ষ্য। ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতি বছর এই দিনটি উৎযাপিত হচ্ছে যাহা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত। এখানে উল্লেখ্য যে, এই দিন আন্তর্জাতিক থ্যালাসেমিয়া ফেডারেশন এর প্রেসিডেন্ট জর্জ এনগ্লেস এর পুত্র থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে যান। পুত্রের স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করার জন্য প্রেসিডেন্ট নিজ উদ্যোগে ঐ দিনকে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই দিবস উৎযাপনের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর অভিভাবকদের এই রোগের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ ও শেষে তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক সাফল্য এনে দিয়েছে। অভিভাবকদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের কারণে সারা বিশ্বের থ্যালাসেমিয়া রোগীরা আজও সেবা ও সহযোগিতা পাচ্ছে। কিন্তু এ সাফল্যের বেশীর ভাগ কেবল মাত্র উন্নত বিশ্বের রোগীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। উন্নয়নশীল দেশে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগী সমাজের একটি বড় বোঝা। অর্থনৈতিক কারণে সঠিকভাবে চিকিৎসা করতে না পারা বিশেষ করে নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন দেওয়া এক্ষেত্রে একটি বড় বাঁধা। এছাড়া নানাবিধ সামাজিক কুসংস্কারতো আছেই। এ্যানিমিয়া বা রক্ত শুন্যতা দেখলেই আয়রন শিরাপ খাওয়ানোর প্রচলন আমাদের দেশে আছে। অথচ থ্যালাসেমিয়া রোগীর ক্ষেত্রে আয়রন ঔষধ খাওয়ানো রোগীদের জন্য ক্ষতিকারকও হতে পারে।
বাংলাদেশ একটি থ্যালাসেমিয়া প্রবণ দেশ। সারাদেশে জালের মত থ্যালাসেমিয়া বাহক ছড়িয়ে আছে। দু’ বাহকের মিলন হলে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর জন্ম হয়। অবশ্য তা শতকরা ২৫% ক্ষেত্রে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩/৪ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। তাহলে অনুমান করা যায় আগামী ১০ বছরে কত হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে। এ সমস্ত শিশুর জন্য প্রয়োজন নিয়মিত রক্ত চঞ্চালন তবে হোল ব্লাড এর পরিবর্তে এ সমস্ত রোগীর পেক রেড সেল এর প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই রক্ত পৃথক করার মেশিন কেবলমাত্র কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে আছে। ফলশ্রুতিতে বেশির ভাগ থ্যালাসেমিয়া শিশু হোল ব্লাড দিচ্ছে যা তার শরীরে তরলের আধিক্য হচ্ছে। বর্তমানে জেলা সদর হাসপাতালেও রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। তবে সেটা সাধারণ শ্রেণির জন্য প্রযোজ্য, থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্য নয়। এছাড়া ঘনঘন রক্ত দেওয়ার কারণে শরীরে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রাকৃতিক নিয়মে এ আয়রন শরীর থেকে নি:স্মরণ হয় না। বিশেষ ধরনের ঔষধের মাধ্যমে এ আয়রণ শরীর থেকে নি:সরণ করতে হয়। বাংলাদেশে ডেসপারল ঔষধটি ইনজেকশনের মাধ্যমে চামড়া নিয়ে দেওয়া হয় তবে এখন তা ব্যবহারিত হয় না। বর্তমানে মুখে খাওয়ার কিছু ঔষধ আছে যেমন- ডেফারিপন ও ডেফারিফেরঙ যা অত্যন্ত দামী। সাধারণ রোগীদের নাগালের বাহিরে। এ ঔষধ বহু জাতীয় ঔষধ কোম্পানী তৈরী করে এবং তা সারাবছর শরীরে আয়রনের পরিমাপ দেখে খেতে হয়। বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়ায় যে সমস্ত রোগী মারা যায় তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধিক আয়রনের কারণে মাল্টিঅর্গান অকার্যকারিতার ফলে মারা যায়। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের অনেক ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। যেমন- ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থের অভাব দেখা দেয়। তাদের হিমোগ্লোবিন কম থাকার কারণে শরীরের বৃদ্ধি হয় না। তাদের চোখের ও কিডনীর সমস্যা দেখা দিতে পারে, হাড় ভেঙ্গে যেতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু কোবিড-১৯ আক্রান্ত হবে না এ ধরনের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তাই থ্যালাসেমিয়া শিশুকেও করোনা পরিস্থিতিতে যাবতীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কোন শিশু যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে যায় তাহলে তাকে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। পাশাপাশি তার হিমোগ্লোবিন মাত্রা ১০ গ্রাম এ থাকার জন্য রক্ত দিতে হবে। আয়রন কমানোর কোন ঔষধ মুখে খাওয়ানো হলে তা করোনা থাকাকালীন সময়ে বন্ধ রাখতে হবে। প্রয়োজনে ইন্‌জেকশন দিবে।
থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসার চেয়ে এ রোগের প্রতিরোধ করায় এখন জরুরি। উন্নত বিশ্বে বর্তমানে থ্যালাসেমিয়া শিশুর জন্ম কম হচ্ছে। কারণ তারা বাহক যাচাই করার মাধ্যমে দুই বাহকের মধ্যে বিবাহ নিরুৎসাহিত করেছে। বাংলাদেশে এ রোগ প্রতিরোধে বাহক যাচাই কর্মসূচি জোড়ালোভাবে নিতে হবে। জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে। সরকার, দাতা সংস্থা ও অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানকে এ ব্যাপারে কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে। তা না হলে আগামী ১০ বৎসরের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া এদেশে একটি অন্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত হবে।
পরিশেষে একজন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে মা বাবারা অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করে। করোনা পরিস্থিতি এটাকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। আশা করছি সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সকল থ্যালাসেমিয়া শিশু এই করোনা পরিস্থিতিতে সুস্থ্য থাকবে। এটাই আমার কাম্য। লেখক : শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ
লেখক : শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ

পূর্ববর্তী নিবন্ধসোনার হরিণ আইসিইউ- অক্সিজেন : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা