কখনো মেঘ, কখনো দুয়েক ফোটা বৃষ্টি। বৈশাখের শেষভাগে এসে বৃষ্টির লুকোচুরি। এবার সহজে বৃষ্টির দেখা মিলছে না। বৈশ্বিক মহামারী প্রকৃতির উপর প্রভাব না পড়লেও চলমান জীবনকে অনেকটা থমকে দিয়েছে। চট্টগ্রাম নগরীর ঐতিহ্যবাহী এলাকা চকবাজার। নানা কারণে বিখ্যাত।
রুমাইসা জাহিন, চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শপিংমলে প্রবেশ করতেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে এগিয়ে এলেন একজন। শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করলেন অন্যজন। প্রবেশকারী, নিরাপত্তাকর্মী সবাই মাস্ক পরিহিত। সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধির পুরোটাই নজরে আসে চকবাজার এলাকার অত্যাধুনিক শপিংমল বালি আর্কেডের প্রবেশ পথে। খোলার দিনে শেঠ গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান শেঠ প্রপার্টিজ নির্মিত চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় শপিং মলটি ঘুরে এমনটি দেখা গেছে।
করোনা পরিস্থিতির কারণেই শপিংমলের প্রবেশ পথে বাড়তি এই সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা। প্রবেশে করতেই ক্রেতাদের নজরে আসবে নিচ তলায় তৈরি পোশাকের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড শৈল্পিক ও স্বদেশ পল্লীর আউটলেটে। ক্রেতাদের আনাগোনাও আশাতীত। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ট্রায়াল রুম সার্ভিস বন্ধ থাকায় পোশাকের মাপ নিয়ে সতর্ক দেখা গেলো কয়েকজনকে। বাটা ও এপেক্সের আউটলেটে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ঈদের জুতা-স্যান্ডেল দেখাতে ব্যস্ত বিক্রয় কর্মীরা।
শিশুর ঈদের পোশাক কিনতে অভিভাবকদের ভিড় জুনিয়রসের আউটলেটে। নতুন ডিজাইনের টি-শার্ট, রেডিমেট প্যান্ট, শার্ট কিনতে তরুণরা এসেছেন র ন্যাশনের আউটলেটে। চারপাশে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা রেখে স্কেলেটর রয়েছে এক জোড়া। স্কেলেটর ব্যবহার করে দ্বিতীয় তলায় উঠতেই সব প্রসাধনীর দোকান। ঈদকে সামনে রেখে রূপচর্চায় আগ্রহী তরুণীদের ভিড় এখানের ক্রিমসন, আল্টিমেট কুইন, মেক আপ জোন, কোরিয়ান কনসেপ্ট, কসমেটিক ওয়ার্ল্ড, রিডের আউটলেটে। পণ্যের মেয়াদ, দাম যাচাই করে এসব আউটলেট থেকে তেল, শ্যাম্পু, আইলাইনার, ফেসওয়াশ আর মেহেদি কিনছিলেন রুমানা, বাসা তার কাপাসগোলা। নববিবাহিতা, করোনাকালীন বিয়ে তাঁর, স্বামী প্রবাসী।
তিনি দৈনিক আজাদীকে জানান, আগে এসব অন্য শপিং মল থেকে কিনতাম। বাসার পাশে আধুনিক সুবিধার নতুন মার্কেট। তাই এখানে এসেছি। ঈদ উপলক্ষে ছাড়ও পেলাম। এখানে রয়েছে- বেবিরি, কিডস জোন, কিডস কিউটি, অ্যারটিক, সক শপ, এম এ কালেকশন। তৃতীয় তলায় নারীর পোশাক ও জুতার দোকান। দেশি-বিদেশি বাহারি থ্রি পিসের সমাহার। তাওয়াক্কুল, মারিয়া বি, বারিশ, আগা নূর -এসব এবার বেশি চলছে। থ্রি-পিস মিলছে ১৮শ থেকে ১৬ হাজার টাকার মধ্যে। ক্রেতার দেখা মিললো এখানের লেডি কেয়ার, নুর, রোকেয়া ফ্যাশন, স্পার্ক গিয়ার, ডায়না ফার্স্ট ফ্যাশন, গ্লসি, স্টাইল ওয়ার্ল্ড, এম এন লেডিস, কুইন্স ওয়ার্ল্ড, ওয়ান টেক্স, বিসমিল্লাহ, ওয়ার্ল্ড অফ আবায়ার আউটলেটে। ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ নীতি মেনে এসব আউটলেটে ঈদের পোশাক বিক্রি হচ্ছে বলে আজাদীকে জানান-ডায়ানার নিক্সন।
ঈদের পোশাক কিনতে চতুর্থ তলার রেড ডিজাইনের আউটলেটে জিন্সের প্যান্ট দেখছিলেন মহসীন কলেজের শিক্ষার্থী নাভেদ আঞ্জুম। তিনি জানান, জুতা, প্যান্ট, শার্ট, পাঞ্জাবি, পায়জামা- সব এক মার্কেটেই। নিচতলা থেকে জুতা নিয়ে এখন প্যান্ট কিনতে এলাম। কালেকশন ভালোই। ক্রেতার দেখা মিলল রয়াল ফ্যাশন ক্লাব, স্পার্ক গিয়ার জেন্টস’, ব্লু ড্রিম, ফিউশন, হুপার, রিচার্জ, বিভি ফ্যাশন, মেগাসিটি, নোকতা, রসিক, পোশাক বাড়িরর আউটলেটেও। ছেলের জন্য পোশাক কিনতে আসা রাফিয়া খানম বলেন, ক্রেতা-বিক্রেতা সবার মুখে মাস্ক দেখে করোনা ভয় কিছুটা কেটে গেছে। পরিবেশও ভালো। একটু ভিড় হলেই নিরাপত্তা কর্মীরা এসে সবাইকে আলাদা করে দিচ্ছেন। পঞ্চম তলাজুড়ে আছে মোবাইল অ্যাক্সেসরিজ এবং ভিভো, স্যামসাং, অপ্পো, নকিয়া, রিয়েল মি-সহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অত্যাধুনিক মোবাইলের সমারোহ। ষষ্ঠ তলাজুড়ে আছে ইন্টারন্যাশনাল লেভেলের বিশাল এক মাল্টি-কুজিন ফুডকোট। এই ফুড কোটে এসেছে ঢাকার বিখ্যাত ব্র্যান্ড হাক্কা-ঢাকা, দিল্লি-দারবার, আমেরিকান বার্গার, থার্ড-হোম, দা পাপা চিনো, ইউ বেরিস, ফরমুচা কিউ কিউ অ্যান্ড সালাদ লাভার, আমেরিকান কুজিন, দা গ্রিল মাস্টার, এক্সপ্রেস থাপায়ানকি, ট্রাইভ, বোন চায়না, বোন ক্যাফে, চপস্টিক, স্পাইসি চিলি, মেজ্জাইন্না বাড়ি, ফুচকাওয়ালা ও জুসবার। উপরের ফ্লোরগুলোতে আছে তিনটি বৃহৎ আকারের সিনেপ্লেক্স, একটি বিশাল অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, নান্দনিক শৈল্পিকতায় ঘেরা বিশাল কনভেনশন হলসহ আধুনিকতার ছোঁয়া ও ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়ে ভরপুর অত্যাধুনিক জিমনেসিয়াম, আরো একটি বিশ্বমানের রেস্টুরেন্ট। এখানে প্রতিদিন চলছে মেহেদি উৎসব, আচার উৎসব ইত্যাদি।
চালুর পর থেকে বালি আর্কেডে জমজমাট বিকিকিনি হচ্ছে জানান শেঠ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোলায়মান আলম শেঠ। তিনি দৈনিক আজাদীকে জানান, সরকার এবং জেলা প্রশাসনের সুরক্ষা নির্দেশনা মেনেই আমাদের ব্যবসায়ীরা বিকিকিনি করছেন। আন্তর্জাতিক মানের সুবিধা, ভালো ও নতুন ডিজাইনের পণ্য, ঈদ উপলক্ষে ছাড়সহ নানা কারণে ক্রেতারা এবার ঈদের কেনাকাটায় নতুন সংযোজন বালি আর্কেডকে বেছে নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘নো মাস্ক, নো এন্ট্রি’ নীতি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। লোকজনের ভিড় এড়াতে শপিং মলের প্রবেশ এবং বের হওয়ার পথ আলাদা রাখা হয়েছে। সোলায়মান আলম শেঠ আরো জানান, চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের চাহিদা ছিলো একটি আন্তর্জাতিক মানের শপিং মলের। বালি আর্কেড নির্মাণ করে আমরা সেই চাহিদা পূরণ করেছি। দুটি বেজমেন্টে কার পার্কিং সুবিধা, ২৬০টি দোকানের মাধ্যমে এক ছাদের নিচেই সব কেনাকাটার ব্যবস্থা রেখেছি আমরা। তিনি অরো জানান, বালি আর্কেড শপিংমল হলো আমাদের শেঠ পরিবারের একটি স্বপ্নের প্রকল্প। চট্টগ্রামে আমাদের বাপ-দাদার অঢেল সম্পত্তি আছে। আমরা চাইলে এই সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা ব্যাংকে রেখে দিতে পারতাম, কিন্তু আমরা তা করিনি। কারণ, আমরা চেয়েছি চট্টগ্রামের মানুষের জন্য নিদর্শন স্বরূপ কিছু করে যেতে, যার মাধ্যমে শেঠ পরিবারের জন্য সবার মন থেকে দোয়া আসবে, সবাই শেঠ পরিবারকে আন্তরিকতার সাথে মনে রাখবে। ইচ্ছে ছিল গত ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে এই প্রকল্পের উদ্বোধন করবো, কিন্তু করোনার জন্য আমরা তা পেরে উঠিনি। সেজন্য গত ২ এপ্রিল বালি আর্কেড উদ্বোধন করি। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে আমাদের এই স্বপ্নের প্রকল্প উৎসর্গ করেছি প্রধানমন্ত্রীকে। চট্টগ্রামের মানুষ এখন গর্ব নিয়ে বলতে পারবে আমাদেরও আছে একটি বিশ্বমানের শপিংমল। এক ছাদের নিচেই আপনারা পাবেন, জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ড শপ, মহিলাদের জন্য আলাদা জোন এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যাবস্থা। আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পুরো চকবাজার এলাকায় সিসি ক্যামেরা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী দিয়ে এই এলাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক বিভাগকে সহায়তা করছি। রাস্তার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করছি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে নিয়মিত রাজস্ব দিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে। আমরা এখন যে হারে মানুষের সমাগম দেখছি, তাতে বলা যায় পরিশ্রম অনেকটা সার্থক।