মজনু’র আকস্মিক মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হলো পরিবারের। কিন্তু চট্টগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার কম ক্ষতি হলো না। আজাদীরও ক্ষতি হলো। সে দৈনিক আজাদীর নিয়মিত কলামিস্ট ছিলো। বহুদিন ধরে লিখছিলো সে। আজাদীর সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সাহেবের অনেক কৃতিত্বের মধ্যে এই একটা বড় কৃতিত্ব যে, তিনি অনেক কলামিস্ট সৃষ্টি করেছিলেন। নাম বলতে গেলে তালিকাটা খুব ছোট হবে না তবু কিছু নাম বলা প্রয়োজন মনে করছি। অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান, অধ্যক্ষ ফজলুল হক, রাইফেল ক্লাবের সেক্রেটারি মোফাচ্ছেল আহমদ চৌধুরী, চুরিয়ালঠুসী লেনের বাসিন্দা ব্যাংকার মোহাম্মদ ইদ্রিছ সাহেব, যিনি পরে সুগন্ধায় বাড়ি করে সেখানে বসবাস করতেন এবং সেখানেই প্রয়াত হন, তিনি ‘অদ্রীশ’ ছদ্মনামে লিখতেন। তিনি ছিলেন ব্যাংকার, তাকেও খালেদ সাহেব লেখক বানিয়ে ছেড়েছিলেন। অন্য সবারও লেখক হওয়ার কথা ছিলো না। কিন্তু খালেদ সাহেবের কল্যাণে তাঁদের লেখক হতে হয়েছিলো। ইদ্রিছ সাহেব খালেদ সাহেবের মস্ত বড় আবিষ্কার। ইদ্রিছ সাহেব চট্টগ্রামের লোক কাহিনী, ধাঁধা এবং প্রবাদ-প্রবচন নিয়ে আজাদীতে যে মূল্যবান লেখা আরম্ভ করেছিলেন, তাতে আমরা চমকে উঠেছিলাম। কিন্তু খালেদ সাহেবের দুর্ভাগ্য ইদ্রিছ সাহেব বেশিদিন লিখতে পারেন নি। কারণ তাঁর স্রষ্টা তাঁকে ডেকে নিয়ে যান। হল্যান্ড থেকে লেখেন বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া, বিকাশ আগে থেকে সাংবাদিক; সিডনি থেকে লেখেন ছড়াশিল্পী ও লেখক অজয় দাশগুপ্ত। ‘ভুগোলের গোল’ লিখে যাচ্ছেন ডা. এ কিউ অহিদুল আলম। সাখাওয়াত হোসেন মজনুকেও মাননীয় খালেদ সাহেব আজাদীর পাতায় নিয়মিত একটি কলাম লেখায় সুযোগ দিয়েছিলেন। আমি উপরে যাদের কথা লিখলাম, মজনু বয়সে তাদের অনেক ছোট। সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদলও আজাদীর একজন নিয়মিত কলামিস্ট। কিন্তু কখন থেকে লিখছেন আমি ঠিক জানি না।
ঢাকায় কবি সিকান্দর আবু জাফর, হাসান হাফিজুর রহমান ও আহসান হাবীবকে বলা হতো লেখক সৃষ্টির কারিগর; আমাদের চট্টগ্রামে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের নামের পাশেও সেই অভিধা আমরা প্রয়োগ করতে পারি।
খালেদ সাহেব আর একটা কাজ করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ ওঠায় তাহেরউদ্দিন ঠাকুর তখন খুব বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। খালেদ সাহেব আজাদীতে কলাম লিখে তাঁর দুঃসময় পার করার সুযোগ দিয়েছিলেন। ঠাকুর সাহেব ‘আরশি নগর’ শিরোনামে কলাম লিখতেন, তাঁর ‘তখল্লস’ বা লেখক নাম ছিলো পড়শী।
সাধু গদ্যে অসাধারণ সব লেখা তিনি লিখেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের পক্ষেই লিখতেন। ঠাকুর ষাটের দশকে ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টার ছিলেন। আজাদীতে কলাম লেখক ছাড়াও আরো নানাদিকে মজনুর প্রতিভা আকৃষ্ট হয়েছিলো এবং সেসব ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভা কর্ষণ করে তিনি আমাদের মূল্যবান সৃষ্টি উপহার দিয়েছেন। মজনুর লেখালেখির ক্ষমতা প্রকাশ পায় স্বাধীনতার পর। স্বাধীনতার পূর্বে তিনি ছিলেন একজন ছাত্রনেতা। সে সময় আগ্রাবাদ ছাত্রলীগের একজন সংগঠক হিসেবে তিনি স্বাধীনতার লক্ষ্যে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলেন। তিনি সোয়াত জাহাজ অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারপত্র বিতরণ ও খবর আদান প্রদান করতেন।
স্বাধীনতার পর সমাজতন্ত্রের ধ্বনি ধরে নতুন রাজনৈতিক দল জাসদ গঠিত হলে মজনু সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে দীক্ষিত হন। জাসদের জন্য কিছুদিন কাজ করার পর মজনু গবেষণা ও লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর চর্চার বিষয়বস্তু ছিলো মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাঁর একটি মৌলিক কাজ হলো বধ্যভূমির অনুসন্ধান ও ইতিহাস রচনা এবং শহীদের তালিকা প্রণয়ন। পাহাড়তলী, টেলিগ্রাফ রোড, ফয়’স লেক ও দামপাড়া বধ্যভূমির সন্ধান দেন তিনি। হালিশহর নাথপাড়া বধ্যভূমির ইতিহাসও প্রথম মজনুই লেখেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসররা বিভিন্ন স্থানে টর্চার ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনকে ধরে ধরে হত্যা করতো ও নির্যাতন চালাতো। এমনি কয়েকটা টর্চার ক্যাম্প হলো-সার্কিট হাউস, গুডসহিল, ডালিম হোটেল, দেওয়ান হোটেল, চামড়ার গুদাম আলবদর ক্যাম্প ইত্যাদি।
মজনুই প্রথম এসব টর্চার ক্যাম্পের তথ্য সংগ্রহ করে বই প্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা ও ইতিহাস চর্চার মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রাম শহর রণাঙ্গনের গ্রুপ কমান্ডার ডা. মাহফুজুর রহমান ছিলেন মজনুর আদর্শ। ১৯৯১/৯২ সালের দিকে চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়নে উদ্যোগী হন। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি সংস্থা গঠন করে তিনি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে থাকেন। মজনু’র তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ১৯৯৩ সালে ডা. মাহফুজের গ্রন্থ “বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম” প্রকাশিত হয়। ডা. মাহফুজ আরো অনেক বই প্রকাশ করেন, যাতে মজনু’র সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য। ডা. মাহফুজ পরে “সাপ্তাহিক অনুবীক্ষণ’’ ও মাসিক ‘স্বাস্থ্যচিন্তা’ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেন মজনু মাহফুজ সাহেবের এই দু’টি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন।
যেক্ষেত্রে মজনু’র বড় অবদান সেটা এখনো বলা হয় নি। সেটা হলো মজনু চট্টগ্রামের মনীষী, খ্যাতিমান ব্যক্তিদের জীবনী রচনা করেছিলেন। তিনি একাই অনেকগুলি জীবনীগ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করেছিলেন। যেমন সাবেক মন্ত্রী ও এমপি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর পিতা যুক্তফ্রন্টের এমএলএ ও পাকিস্তানের মন্ত্রী মাহমুদুন্নবী চৌধুরীর জীবনী, মানবতাবাদী চিকিৎসক ডা. এমএ হামেশের জীবনী, ডা. আফছারুল আমীনের পিতা গরীবের ডাক্তার হিসেবে খ্যাত ফজলুল আমীনের জীবনী, অধ্যক্ষ শাফায়াত আহমদ সিদ্দিকীর জীবনী, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবুল মিয়ার জীবনী। একজন ব্যক্তির পক্ষে এসব মানুষের জীবনী রচনা করা কঠিন কাজ। কিন্তু জীবনচেষ্টার সাখাওয়াত হোসেন মজনু এই কঠিন কাজটি সহজ করে নিয়েছিলেন। সেজন্যই আমি প্রথমে বলেছি মজনু’র মৃত্যুতে চট্টগ্রামের ক্ষতি হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক সংগঠক