আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস আজ। এমন এক সময়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে, যখন বিশ্বে চলছে ভয়াবহ অবস্থা। কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে এলো সেই মহান মে দিবস। একদিকে করোনা ভাইরাসের আক্রমণে জীবন হারানোর আশঙ্কা, সারাক্ষণ ভয়-আতঙ্কে বসবাস; অন্যদিকে উপার্জনহীন অবস্থায় অনাহার-অর্ধাহারে দিনযাপনের দুঃখ-কষ্ট। জীবন ও জীবিকার উভয় দিক মিলিয়ে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ আজ এক ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। তবু আমরা মে দিবসের সংগ্রামী ঐতিহ্যের কথা, সুদীর্ঘ সংগ্রামের অর্জনগুলোর কথা ভুলে যেতে পারি না। আমাদের শ্রমজীবী মানুষের অনুপ্রেরণার উৎসস্থল এ মে দিবস। আমরা সবসময় ত্যাগ-তিতিক্ষাময় অদম্য অক্লান্ত সেই সব সংগ্রামের স্মৃতি থেকে প্রেরণা ও শক্তি অর্জন করতে চাই।
১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকেরা আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। সেদিন শ্রমিকেরা ১০-১২ ঘণ্টার কর্মদিবসের বিপরীতে আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন। সেই আত্মদানের পথ ধরে পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমজীবী মানুষদের দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করতে হয়েছে ন্যায্য মজুরি, অবকাশ, মানবিক আচরণ, স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবিতে। আট ঘণ্টার কর্মদিবসের দাবি অর্জিত হয়েছে, কর্মপরিবেশেরও কিছুটা উন্নতি হয়েছে; কিন্তু শ্রমজীবীদের পেশাগত জীবনে নিরাপত্তা ও মানবিক অধিকারগুলো অর্জিত হয়নি।
কার্ল মার্ঙ হিসাব করে দেখিয়ে ছিলেন মালিকের মুনাফা বাড়ানোর পথ দুটি। শ্রমিকের শ্রম, সময় বাড়ানো আর যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো। ফলে কর্মঘণ্টা বাড়ছে, উৎপাদন বাড়ছে। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব। বিপুলসংখ্যক বেকার শ্রম বাজারে রিজার্ভ আর্মির কাজ করছে বলে কম মজুরিতেই তাদের কাজ করানো সম্ভব হচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবস্থা কেমন! এ বিষয়ে রাজেকুজ্জামান রতন তাঁর এক লেখায় বলেন, প্রতি বছর শ্রমবাজারে কাজ প্রত্যাশী ২০/২২ লাখ তরুণ-যুবক আসে যাদের মাত্র দুই লাখের মতো কর্মসংস্থান রাষ্ট্র করতে পারে। এরপর, সাত থেকে ১০ লাখ মানুষ পাড়ি জমায় বিদেশে কাজ করতে। আর বাকিরা দেশে কোনোমতে কাজ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে। দেশের ছয় কোটি ৩৪ লাখ শ্রমজীবীর মধ্যে প্রায় তিন কোটি কাজ করে কৃষিখাতে। যেখানে বছরে ৩ মাসের বেশি কাজ থাকে না ফলে বহু ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের মাধ্যমে তারা টিকে থাকার চেষ্টা করে। এর বাইরে ৪০ লাখ শ্রমিক গার্মেন্টসে; ৩০ লাখের বেশি নির্মাণ খাতে; ৫০ লাখ পরিবহন খাতে; ১০ লাখের বেশি দোকান কর্মচারী; পাট, চা, চামড়া, তাঁত, রি রোলিং, মোটর মেকানিক, লবণ, চিংড়ি, সংবাদমাধ্যম, হাসপাতাল-ক্লিনিক, পুস্তক বাঁধাই, হকার, রিকশা-ভ্যান চালক, ইজি-বাইক চালক, সিকিউরিটি গার্ডসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করছে। শ্রম শক্তির ১ কোটি ২ লাখ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে আর বাকিরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকে। মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে ৪৩টি সেক্টরের শ্রমজীবীদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের ব্যবস্থা থাকলেও বাকি কোটি কোটি শ্রমিকের ‘কাজ নাই তো মজুরি নাই’ নীতিতে কাজ করানো হয়ে থাকে। শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার পথে আইনি এবং আইন বহির্ভূত অসংখ্য বাধা।
যদিও আজ বাংলাদেশের শ্রম পরিবেশ অতীতের তুলনায় যতটা এগিয়েছে, তার পেছনেও রয়েছে শ্রমিকদের ত্যাগ ও সংগ্রাম। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরির দাবি এখনো উপেক্ষিত, এখনো তাঁদের বিরাট অংশ মৌলিক মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত।
এই করোনাকালে শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশার কমতি নেই। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের তুলনায় অনানুষ্ঠানিক খাতের বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের কর্মহীন-আয়হীন অবস্থার দুঃখ-কষ্ট অপেক্ষাকৃত বেশি শোচনীয়। তাদের অর্থনৈতিক নাজুক দশার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আমাদের এই আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাঁদের জন্য আসলে কোনো সুরক্ষা নেই। লকডাউনের ফলে তাঁদের জীবনে যে অনাহারী দশা দেখা দিয়েছে, তা সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যৎসামান্য ত্রাণসামগ্রী দিয়ে কি দূর করা সম্ভব? কর্মহীন শ্রমিক শ্রেণির জন্য আমাদের ভাবতে হবে। আজ এ মহান দিনে আমরা বাংলাদেশের ও সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষকে মে দিবসের শুভেচ্ছা ও সংহতি জানাই।