রাতের আঁধারে তালা ভাংলো। ভেতরে প্রবেশ করলো। চুরি করে নিয়ে গেল মামলার আলামত। যাওয়ার সময় নতুন একটি তালাও লাগিয়ে দিলো। দুই বছর আগে ঠিক এমনটি ঘটেছিল চট্টগ্রামের আদালত পাড়ায় অবস্থিতি জেলা পুলিশের মালখানায়। মামলার প্রাণ বলা হয় যে আলামতকে, সে আলামত রাখার মালখানাতেই চুরির ঘটনায় তখন চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। তখন আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী থেকে শুরু করে সব মহলের একটিই প্রশ্ন ছিল- মালখানা থেকে কিভাবে মামলার আলামত চুরি হয়ে যায়?
স্পর্শকাতর এ ঘটনার পর দুই দুটি বছর কেটে গেছে। অথচ কে বা কারা পুলিশী নিরাপত্তা ফাঁকি দিয়ে রাতের আঁধারে মালখানার গেইটের তালা ভাংলো, কারা সেখান থেকে মামলার আলামত চুরি করে নিয়ে গেল তা আজও জানা যায়নি। এছাড়া মালখানা থেকে ঠিক কতগুলো মামলার আলামত চুরি হয়ে গেল তা এখনো পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। প্রথমে টাকা, ইয়াবাসহ ৬৪টি আলামত চুরি হয়ে গেছে মর্মে স্টেটমেন্ট দেয়া হলেও পরে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়- সমান্য কিছু কাগজপত্র চুরি হয়েছে।
এ ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় করা মামলারও আশানুরূপ কোনো অগ্রগতি হয়নি। প্রথম দিকে উপ-পরিদর্শক পলাশকে মামলার তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হলেও পরে দায়িত্ব পান জাবেদুল আলম নামে কোতোয়ালী থানার একজন পরির্দশক। আদালত ও পুলিশ সূত্র জানায়, মালখানা চুরির ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় করা উক্ত মামলায় গত বছরের শেষ দিকে কাউকে শনাক্ত করা যায়নি মর্মে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন উপ-পরিদর্শক পলাশ। তার এ প্রতিবেদনে আদালত তখন সন্তুষ্ট হতে পারেননি। যার ফলে আদালত সিনিয়র কাউকে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার তদন্ত কাজ সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিল করতে আদেশ দেন। তখন থেকে জাবেদুল আলমই এ মামলার তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন।
এদিকে বহুল আলোচিত এ মামলার তদন্ত কাজের অগ্রগতি কতটুকু বা কাউকে শনাক্ত করা গেছে কিনা, ঠিক কতগুলো মামলার আলামত চুরি হয়ে গেছে এমন প্রশ্নের উত্তরে কিছুই জানাতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তা জাবেদুল আলম। আজাদীর পক্ষ থেকে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশ মর্মে আমি মামলাটির তদন্ত করছি। তদন্ত কাজ চলছে। এখনো পর্যন্ত বলার মতো কিছুই নেই। তবে মামলার বাদী ও সাক্ষীদের সাথে কথা বলেছি। আশা করছি খুব দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে পারব। এ বিষয়ে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন ও নগর পুলিশের জনসংযোগ কর্মকর্তা ও এডিসি শাহ মোহাম্মদ আব্দুর রউফের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা আজাদীকে জানান, মামলাটি আদালতের নির্দেশে উপ-পরিদর্শক পলাশ থেকে নিয়ে পরিদর্শক জাবেদুল আলমকে দেয়া হয়েছে। তিনি তদন্ত কাজ শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করবেন।
২০১৯ সালের ১৭ মার্চ রাতে নতুন আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকা জেলা পুলিশের মালখানায় চুরির ঘটনা ঘটে। মালখানার তৎকালীন ইনচার্জ শওকত হোসেন পরদিন প্রতিদিনের মতো তালা খুলে প্রবেশ করতে গিয়ে সেখানে নতুন একটি তালা দেখতে পান। আগের দিন মালখানার কার্যক্রম শেষ করে লাগানো তালাটি সেখানে তিনি আর পাননি। বিষয়টি তাৎক্ষণিক খটকা লাগলে তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবগত করেন এবং নতুন তালাটি ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন। ভেতরে প্রবেশ করেই তিনি বুঝতে পারেন মামলার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলামত চুরি হয়ে গেছে। পরে জেলা ও নগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং ঘটনার সময় মালখানা পাহারার দায়িত্বে থাকা কনস্টেবল খলিলুর রহমান ও মনিরুজ্জামানকে সাময়িক বহিষ্কার করেন।
তারপর মালখানার ইনচার্জ শওকত হোসেন বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এছাড়া চুরির ঘটনার একদিন পর ১৯ মার্চ জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, মোট ৬৪টি আলামত মালখানা থেকে খোয়া গেছে। তার মধ্যে ছিল ২৭ লাখ নগদ টাকা ও ৩৫ হাজার পিস ইয়াবা। ঘটনা তদন্তে জেলা পুলিশ ও চীপ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক দুটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে করা তদন্ত টিমের প্রধান করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান ভূঁইয়াকে। তদন্ত শেষে তিনি তখন একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করেন। সে প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, মালখানা থেকে ওই রাতে তেমন কিছু চুরি যায়নি। শুধুমাত্র মালখানার কিছু কাগজপত্র খোয়া গেছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা আইনজীবী সমিতির সেক্রেটারি এএইচএম জিয়া উদ্দিন আজাদীকে বলেন, কঠোর পুলিশী নিরাপত্তার মধ্যে মালখানা থেকে মামলার আলামত চুরি যাওয়ার অর্থ হচ্ছে- সর্ষের মধ্যে ভূত আছে। না হলে এখনো পর্যন্ত তালা ভাংলো কে তা জানা গেল না কেন? কারা এ ঘটনা ঘটালো তা বের করতে না পারাটা সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা। সংশ্লিষ্টদের উচিৎ যারাই জড়িত থাকুক তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং বিচার নিশ্চিত করা। মামলাটির সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে এএইচএম জিয়াউদ্দিন আরও বলেন, ন্যায় বিচার ও বিচারপ্রার্থীদের স্বার্থ বিবেচনায় বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা দায়ীদের শনাক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করবেন বলে আশা করছি।
উল্লেখ্য, নতুন আদালত ভবনের ১ম তলায় জেলা পুলিশের ও দ্বিতীয় তলায় রয়েছে নগর পুলিশের মালখানা। এ দুটি মালখানায় বর্তমানে রয়েছে বিচারাধীন প্রায় ৫০ হাজার মামলার আলামত। বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ দুটি মালখানায় নগর ও জেলার ৩২ থানার হত্যা, অস্ত্র, ডাকাতি, মাদক, চোরাচালানসহ বিভিন্ন মামলার আলামত সংরক্ষণ করা হয়। যেসব মামলা নিষ্পত্তি হয় তার মধ্যে মদ, ফেনসিডিল, ইয়াবা ও গাঁজাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য ধ্বংস করা হয়। আর গাছ, গাড়ি, স্বর্ণ, শাড়িসহ ব্যবহার্য জিনিস প্রকাশ্য নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। বিক্রির পর ওই টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়। জানা গেছে, একসময় এ দুটি মালখানা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল সরকারের নির্বাহী বিভাগ তথা জেলা প্রশাসন। ২০০৭ সালের পর থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের মাধ্যমে জেলা জজের উপর দায়িত্ব অর্পিত হয়।








