কক্সবাজারে হিমছড়ি সৈকতে দুটি তিমির মৃতদেহ ভেসে আসার ১৫ দিন পার হলেও এখনো তাদের প্রজাতি সম্পর্কে একমত হতে পারেননি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিএফআরআই) ও বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে তিমি দুটির ডিএনএ পরীক্ষার জন্য গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউট হতে নমুনা সংগ্রহ করেছে বন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট’। তবে তিমি দুটির ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে কেবল তাদের প্রজাতিই চেনা যাবে, তাদের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জানতে প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টের প্রয়োজন বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
চলতি মাসের ৯ তারিখ হিমছড়ি সৈকতে সামুদ্রিক জোয়ারের সাথে ৪৪ ফুট দীর্ঘ একটি তিমির মৃতদেহ ভেসে আসে। পরদিন এর এক কিলোমিটার দক্ষিণে প্রায় একই আকারের আরেকটি তিমির মৃতদেহ পাওয়া যায়। এরপর ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) আমিন আল পারভেজের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। তবে ওই কমিটির কাজ মৃত তিমি দুটির সমাহিত করা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল বলে জানান এডিসি আমিন আল পারভেজ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউট ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা মৃত তিমি দুটির নমুনা সংগ্রহ করেছেন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তারা আমাদের রিপোর্ট দেবেন।
মৃত তিমি দুটির নমুনা সংগ্রহকারী বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানী দলের প্রধান ও বায়োলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সাঈদ মুহাম্মদ শরীফ বলেন, ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে ব্রাইডস হুয়েল জাতের তিমির সুনির্দিষ্ট প্রজাতি সম্পর্কে তথ্য জানা যাবে। এ জাতের তিমির মোট পাঁচটি প্রজাতি রয়েছে। তবে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে প্যাথলজিক্যাল টেস্টের যে নমুনা দরকার, সেই নমুনা আমরা সংগ্রহ করিনি। সেই দায়িত্ব বনবিভাগের। তিনি বলেন, আমরা কেবল আমাদের গবেষণার জন্যই নমুনা সংগ্রহ করেছিলাম। একই তথ্য জানান বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান ড. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, তিমি একটি সামুদ্রিক প্রাণি হলেও তা সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছে বনবিভাগ। তবে আমরা নমুনা সংগ্রহ করলেও করোনার কারণে এখনই টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করতে পারছি না। পরে সেটা যেকোনো সময় করা যাবে।
সামুদ্রিক প্রাণি তিমি সংরক্ষণের দায়িত্ব বনবিভাগের হলেও চলতি মাসে কঙবাজারের হিমছড়ি সৈকতে ভেসে আসা তিমির মৃতদেহের কোনো নমুনা তারা সংগ্রহ করেছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বন মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে গত ১৫ এপ্রিল বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের পক্ষ হতে মৃত তিমি দুটির ডিএনএ নমুনা ‘ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের’ পরিচালকের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে এবং এর দুদিন পর সেই নমুনা তারা পাওয়ার কথা নিশ্চিতও করেছে বলে জানান বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, আমাদের পাঠানো ডিএনএ নমুনা হাতে পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে বনবিভাগ। তবে সেই রিপোর্ট তৈরি হতে কত সময় লাগতে পারে তা নিশ্চিত করতে পারেনি তারা। হয়তঃ ২/৩ মাস সময় লাগতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট’ এর পরিচালক এএসএম জহিরউদ্দিন আকন বলেন, আমরা মৃত তিমি দুটির প্রজাতি শনাক্ত করতেই ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছি। প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে কঙবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাজমুল হক গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, ঘটনারদিন আমি কর্মস্থলে ছিলাম না। তবে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা সংগ্রহ করেছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। তবে সেই নমুনা এখন কোথায়, তা আমার জানা নেই।
এদিকে তিমি দুটির জাত নিয়ে কঙবাজারের মৎস্য বিজ্ঞানীরা একমত হলেও লিঙ্গ নিয়ে এখনও তাদের মতানৈক্য রয়ে গেছে। রোববার রাতে এবিষয়ে চার বিজ্ঞানীর সাথে কথা বললে তিন বিজ্ঞানীর ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, হিমছড়ি সৈকতে ভেসে আসা তিমি দুটির প্রথমটি পুরুষ এবং দ্বিতীয়টি মহিলা, বিএফআরআইর সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পিএইচডি ফেলো) আশরাফুল হক মনে করেন, ঠিক উল্টোটা; মানে প্রথমটি মহিলা এবং দ্বিতীয়টি পুরুষ। আবার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান ড. শফিকুর রহমান উভয় তিমি পুরুষ লিঙ্গের বলে মনে করেন।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের বায়োলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি বিভাগের প্রধান আবু সাঈদ মুহাম্মদ শরীফ বলেন, আমরা মৃত তিমি দুটির মর্ফোমেট্রিক (বাহ্যিক রূপ) পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছি তিমি দুটির প্রথমটি পুরুষ এবং দ্বিতীয়টি মহিলা। একই দাবি করেন বিএফআরআইর বিজ্ঞানীদ্বয়ও।
কঙবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা হুমায়ূন কবীর বলেন, সাগরের কয়েকটি প্রাণি সংরক্ষণের দায়িত্ব বনবিভাগের উপর বর্তালেও সাগরে এক ইঞ্চি যাওয়ার মতো সরঞ্জামও বনবিভাগের নেই। আবার সাগরের কোনো প্রাণির প্রজাতি শনাক্ত করার মত যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো বিশেষজ্ঞও বনবিভাগের নেই।