দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় করোনাভাইরাসে এবার আক্রান্তের হার বেশি। উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এই সময়ে প্রথম ঢেউয়ের অভিজ্ঞতা কতটা কাজে লাগছে এবং দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতিও কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গতবছর করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে অনেকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে চট্টগ্রাম। হাসপাতালে শয্যা সংকট, অক্সিজেন-আইসিইউর জন্য হাহাকারে ভারি হয়ে উঠে চট্টগ্রামের বাতাস। প্রথম দিকে বেসরকারি কোন হাসপাতাল করোনা রোগীর চিকিৎসা দিতেও রাজি হয়নি। কেবল হাতে গোনা কয়েকটি সরকারি হাসপাতালেই করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। ব্যক্তিগত চেম্বারেও রোগী দেখা বন্ধ করে দেন চিকিৎসকরা। এতে করে অন্যান্য রোগীরাও যথাযথ চিকিৎসা পাননি। তবে মানবিক উদ্যোগ হিসেবে চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতাল ও বিদ্যানন্দ হাসপাতালের পাশাপাশি বেশ কয়টি আইসোলেশন সেন্টার গড়ে উঠে চট্টগ্রামে।
এবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে পরিস্থিতি অনেকটা ভিন্ন। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি সব হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। যার কারণে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও হাসপাতালের শয্যা সংকট ততটা প্রকট হয়ে উঠেনি। আইসিইউ শয্যার ক্ষনিকের সংকট দেখা দিলেও আগের মতো হাহাকার পড়েনি। সময় কমিয়ে দিলেও চিকিৎসকরা ব্যক্তিগত চেম্বারও পুরোপুরি বন্ধ রাখেননি। অন্যান্য রোগীরাও চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন। সবমিলিয়ে প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় করোনা চিকিৎসায় চট্টগ্রামের পরিস্থিতি বর্তমানে অনেক ভালো বলে মনে করেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি। তিনি বলেন- করোনা রোগীদের চিকিৎসায় চিকিৎসক-নার্সরা এখন বেশ অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। সম্পূর্ণ নতুন রোগ হওয়ায় প্রথম দিকে কেউ ঠিকমতো বুঝতে পারেননি। এক ধরণের ভয়ও কাজ করেছিল। যার কারণে ওই সময় রোগীর কাছেও অনেকে যেতে চাননি। সময়ের সাথে সাথে সে ভয় এখন অনেকটা কেটে গেছে। চিকিৎসকরাও অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। আইসিইউ-সেন্ট্রাল অক্সিজেনসহ চিকিৎসা সুবিধাও অনেক বেড়েছে। মোটকথা পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো। এটি প্রথম ঢেউ থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে হয়েছে বলে মনে করেন সিভিল সার্জন।
চিত্র তুলনামূলক উন্নত হলেও সংক্রমণের তীব্রতা বাড়লে পরিস্থিতি মোকাবেলা নিয়ে শঙ্কা রয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া। তিনি বলেন- পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকলে শুধু চিকিৎসক-নার্সের অভিজ্ঞতা দিয়ে কার্যকর ফল পাওয়া যাবেনা।
ডা. সুশান্ত বড়ুয়া বলছেন, প্রতিবেশি দেশ ভারতের অবস্থা আমরা দেখছি। ভারতের মতো পরিস্থিতি আমাদের এখানেও হতে পারে। তাই আগামীর পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরি প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই। প্রস্তুতি হিসেবে অন্তত হাজার শয্যার হাসপাতাল বা আইসোলেশন সেন্টার গড়া প্রয়োজন। আইসিইউ শয্যা বাড়ানোর পাশাপাশি সব হাসপাতালেই সেন্ট্রাল অঙিজেন স্থাপন এখন সময়ের দাবি। এসব কাজ দ্রুতই করতে হবে। চিকিৎসক-নার্স কেবল চিকিৎসা সেবা দিতে পারবেন। হাসপাতালের শয্যা কিংবা আইসিইউ-অক্সিজেন না থাকলে তাদের কিছু করার থাকবেনা।
জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় মহানগরের পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোও প্রস্তুত করার তাগিদ দিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রবিউল আলম। উপজেলা হাসপাতালগুলোতেও অক্সিজেন সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। এই চিকিৎসক বলেন, চিকিৎসা সহায়তায় প্যারামেডিক, সাকমো ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষন দেয়া জরুরি। কারণ, স্বল্প সংখ্যক চিকিৎসক-নার্স দিয়ে বিশাল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যাবেনা। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত প্যারামেডিক, সাকমো ও স্বেচ্ছাসেবকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
গত এক বছরের অভিজ্ঞতায় স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া। হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এই হাসপাতালটি একবছর পরও মুমূর্ষু অবস্থায়। আইসিইউ থাকলেও তা একবছরেও চালুর ব্যবস্থা করা যায়নি। চরম ব্যবস্থাপনার কারণেই এমন অবস্থা বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে, সংক্রমনের শুরু থেকেই করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও বিআইটিআইডি হাসপাতাল। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালও এই তালিকায় যুক্ত হয়। শুরুতে জেনারেল হাসপাতাল ও বিআইটিআইডি হাসপাতালের দুটির কোনটিতেই আইসিইউ ও সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা ছিলনা। পরে জেনারেল হাসপাতালে প্রথমে দশটি আইসিইউ শয্যা চালু করা হয়। বসানো হয় অঙিজেন প্লান্ট। স্থাপন করা হয় সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম। পরবর্তীতে আরো ৮টি আইসিইউ শয্যা স্থাপনের কাজ শুরু হয় গত বছরের মে মাসে। কিন্তু প্রায় একবছর পর নতুন ৮টি আইসিইউ উদ্বোধন করা হলেও চালু করা যায়নি। উদ্বোধনের ১০/১২ দিন পর অবশেষে এসব আইসিইউর সেবা চালু হয়। বিআইটিআইডি হাসপাতালেও অক্সিজেন প্লান্টসহ ৫টি আইসিইউ শয্যা স্থাপনের কাজ চলছে বর্তমানে। অর্থাৎ শুরুর দিকে আইসিইউ-সেন্ট্রাল অক্সিজেনবিহীন অনেকটা ঢাল-তলোয়ার ছাড়াই করোনা যুদ্ধে নামেন চিকিৎসক-নার্সরা। তবে পরিস্থিতি এখন অনেকটা বদলেছে। এসব হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধা অনেকটা বেড়েছে। করোনা চিকিৎসায় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল বর্তমানে অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে মনে করেন হাসপাতালটির করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. আব্দুর রব মাসুম। চমেক হাসপাতালেও সব ধরণের চিকিৎসা সুবিধা বিদ্যমান। বরং করোনা আক্রান্ত রোগীদের ডায়ালাইসিস সেবার ব্যবস্থাও রয়েছে চমেক হাসপাতালের করোনা ব্লকে। আর অঙিজেন প্লান্টসহ আইসিইউ শয্যা স্থাপন শেষে চালু হলে বিআইটিআইডি হাসপাতালেও চিকিৎসা সুবিধা অনেকটা বাড়বে বলে জানান বিআইটিআইডি হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশীদ।
অন্যদিকে, দ্বিতীয় ঢেউয়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সুবিধা বাড়লেও গতবছরের মতো মানবিক তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি এবার। কেবল বিদ্যানন্দের হাসপাতাল ও সিটিকর্পোরেশনের একটি আইসোলেশন সেন্টার চালুর কথা জানা গেছে। অবশ্য করোনা পরিস্থিতিতে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ভূমিকাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দিন-রাত এক করে করোনার মহামারী পার করছেন। ছুটির দিন বলতে ঠিক কবে কাটিয়েছেন, করোনাভাইরাস তাও যেন তাদের ভুলিয়ে দিয়েছে।












