জাকাত গরিবের প্রতি অনুগ্রহ নয়, গরিবের অধিকার

ড. আ. ম. কাজী মুহাম্মদ হারুন উর রশীদ | শুক্রবার , ২৩ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:৫১ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম প্রধান ভিত্তি ও বাধ্যতামূলক আর্থিক ইবাদত জাকাত। সমাজের ধনী-গরিবের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরণের একটি বিরাট উপকরণ। ইসলামে কোনো ব্যক্তির উপার্জিত অর্থের পুরোটাই এককভাবে নিজেকে ভোগ করার অধিকার দেওয়া হয়নি; বরং বছর শেষে নিসাব পরিমাণ ধন-সমপদ হলে এর দ্বারা গরিব আত্মীয়-স্বজন, নিঃস্ব এবং হতদরিদ্র লোকদের সাহায্য করতে হয়। যাতে তারাও উপার্জনক্ষম হতে পারে। মানুষ সমপদের জাকাত দিলে জাকাতদাতার সমপত্তি কমে না; বরং জাকাতদাতার সমপদ আরও বহু গুণে বৃদ্ধি হয়।
পবিত্র কুরআনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিরাশি আয়াতে জাকাতের তাগিদ এসেছে। আভিধানিক নিয়মে জাকাতের দু’টি অর্থ রয়েছ। একটি বর্ধিত হওয়া। অপরটি পবিত্র করা। পরিভাষায়- কোনো কিছুর বিনিময় ব্যতিরেকে শরিয়তের নির্দেশিত খাতে নিজের মাল সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরিব-মিসকিন ও অভাবী লোকদের মাঝে বন্টন করাকে জাকাত বলা হয়। জাকাত দ্বিতীয় হিজরিতে মদিনায় ফরজ করা হয়।
কুরআনুল করিম থেকে জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই প্রত্যেক নবীর উম্মতের ওপর সমানভাবে নামাজ ও জাকাতের কঠোর নির্দেশ ছিলো। জাকাত থেকে কেউই রেহাই পায়নি। যেমন: কুরআনে হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর বংশের পরবর্তী নবীদের কথা আলোচনার পর বলা হয়েছে- ‘আমি তাদেরকে মানুষের নেতা বানিয়েছি। তারা আমার বিধানানুযায়ী মানুষদের পরিচালিত করে, পথ-প্রদর্শন করে। আমি ওহীর সাহায্যে তাদেরকে ভাল কাজ করার , নামাজ কায়েম করার এবং জাকাত প্রদান করার আদেশ দিয়েছি। আর তারা আমারই ইবাদত করতো।’ -(সুরা আম্বিয়া, আয়াত:৭৩)।হজরত ইসমাইল (আ.) সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘সে তার পরিবার-পরিজনকে নামাজ ও জাকাতের নির্দেশ দিতো।’ -(সুরা মারয়াম,আয়াত:৫৫) হজরত মুসা (আ.) ইহকাল ও পরকালের জন্য দোয়া করলে এর জবাবে আল্লাহপাক বলেন- ‘আমি যাকে চাই তাকে আমার আজাব দেই। আর আমার রহমত সব বস্তুকে পরিব্যাপ্ত করেছে। সুতরাং আমি তা লিখে দেবো তাদের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং জাকাত প্রদান করে। আর যারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি ঈমান আনে।’ -(সুরা আরাফ,আয়াত: ১৫৬)। রাসুলে করিম (সা.)-এর আগে হজরত ইসা (আ.)-কেও একই সঙ্গে নামাজ ও জাকাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।আল্লাহ্‌তায়ালা ইরশাদ করেন-‘আমি যেখানেই থাকি না কেনো তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতোদিন আমি জীবিত থাকি; ততোদিন সালাত ও জাকাত আদায় করতে।’ -(সুরা মারয়াম,আয়াত: ৩১)
এ আয়াতগুলো থেকে জানা যায়, প্রত্যেক নবীর সময়ই নামাজ ও জাকাত ফরজ ছিলো। এক আল্লাহর বিশ্বাসী কোনো জাতিকেই নামাজ ও জাকাত থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হয়নি।জাকাত সম্পর্কে হাদিসে সরাসরি নির্দেশ রয়েছে।একবার হজরত জিবরাইল (আ.) মানুষ বেশে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! ইসলাম কি?তিনি বললেন- ইসলাম হলো তুমি এ কথার সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ্‌ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল। নামাজ কায়েম করবে। জাকাত প্রদান করবে। আর রমজান মাসের রোজা রাখবে এবং পথ খরচে সামর্থ্য থাকলে হজ্ব পালন করবে।’- (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং- ১) আরেকটি হাদিসের মধ্যে এসেছে,হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, জনৈক বেদুঈন ব্যক্তি নবী করিম (সা.)-এর খিদমতে এসে বললেন- ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমাকে এমন একটি আমল বাতলিয়ে দিন যা করলে আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবো। নবী করিম (সা.) বললেন- তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সাথ কোনো কিছুকে শরিক করবে না। ফরজ নামাজ কায়েম করবে,ফরজ জাকাত প্রদান করবে এবং রমজানের রোজা পালন করবে। তিনি বললেন, যার হাতে আমার প্রাণ সে সত্তার কসম! আমি এ থেকে কিছু বৃদ্ধিও করবো না এবং কমও করবো না। তখন ঐ ব্যক্তি ফিরে যাওয়ার কালে নবী করিম (সা.) বললেন- জান্নাতী কোনো ব্যক্তিকে দেখে কেউ যদি আনন্দিত হতে চায় তাহলে সে যেন এ ব্যক্তিকে দেখে নেয়।’- (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং- ১২)
রাসুলুল্লাহ(সা.)-এর ইন্তেকালের পর কিছু সংখ্যক সাহাবি জাকাত দিতে অস্বীকার করায় ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) জাকাত বিরোধী লোকদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে দীপ্তকন্ঠে বলেছিলেন- আল্লাহ্‌র শপথ! যে নামাজ এবং জাকাতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে (অর্থাৎ, নামাজ আদায় করতে প্রস্তুত থাকে; কিন্তু জাকাত আদায় করতে অস্বীকৃতি জানায়) আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবো, তাদেরকে হত্যা করবো। -(সহিহ আল-বুখারি, হাদিস নং-১৪০০) কারণ, জাকাত অস্বীকারকারীরা প্রকৃত মুমিন থাকে না।
আল্লাহপাক নামাজের সাথে সাথে জাকাতের তাগিদ দিয়েছেন। আল্লাহপাক রাসুল (সা.)-কে জাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন -‘হে রাসুল! আপনি মুসলিমদের অর্থ সম্পদ থেকে জাকাত গ্রহণ করুন। এই জাকাত তাদেরকে পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে। আর আপনি তাদের জন্য দোয়া করুন। নিঃসন্দেহে আপনার দোয়া তাদের জন্য সান্ত্বনার কারণ হবে। আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।’ -(সুরা তাওবাহ, আয়াত: ১০৩)।
নামাজ ও জাকাত মুসলিমদের আবশ্যই করণীয়। যারা জাকাত প্রদান করে না, তাদের পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেছেন-‘যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না, তাদের বেদনাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। যে দিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের কপালে, পার্শ্বে এবং পিঠে সেঁক দেওয়া হবে। সে দিন বলা হবে এগুলো হলো তাই,যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা করেছিলে। সুতরাং যা জমা করেছিলে তার স্বাদ উপভোগ করো।’-(সুরা তাওবা, আয়াত: ৩৪-৩৫)।
মুসলিম সমাজ ব্যবস্থায় জাকাতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাকাতের মাধ্যমে নিজের ধন-সম্পদকে পবিত্র করা যায় এবং জাকাত বিত্তবান ও বিত্তহীনদের একটি সেতুবন্ধন। জাকাত সামাজিক চেতনায় বিকাশ ঘটায়।রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আদ্দু জাকাতা আমওয়ালিকুম’। অর্থাৎ, তোমরা তোমাদের ধন-সমপদের জাকাত আদায় করে দাও। -(সুনান আত-তিরমিজি, হাদিস নং-৬১৬) জাকাত প্রদানের মাধ্যমে মানুষ অনুভব করে সকল সম্পদই আল্লাহর, আমাদের কিছুই নয়। জাকাত মানুষের বিবেককে জাগ্রত করে এবং সমাজের মানুষ ঐক্যবদ্ধ সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।
আসুন, আমরা জাকাতের যথাযথ হক আদায় করে ইহকাল ও পরকাল উভয়ের সমৃদ্ধি লাভ করি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।
লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক; প্রফেসর, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধসংসার চালাতে দিশেহারা নাইক্ষ্যংছড়ির কর্মহীন মানুষ