বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড প্রকল্পে কাটা সেই পাহাড়গুলোতে ধস শুরু হয়েছে। খাড়াখাড়িভাবে কাটা এসব পাহাড় ধসে যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় দুর্ঘটনাও। তাই ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অংশে সড়কের একপাশ বন্ধ করে দিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। সিডিএর প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তারা বলছেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের চাহিদার প্রেক্ষিতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সমন্বয়ে চার সদস্যের একটি কমিটি কাজ করছে। কমিটির প্রতিবেদন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সম্মতির পরই ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো নতুন করে কাটা হবে।
জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট টোল রোডের মুখ থেকে বায়েজিদ বোস্তামি পর্যন্ত সংযোগ সড়কটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সিডিএ। প্রকল্পের আওতায় একটি রেলওয়ে ওভারব্রিজসহ ছয়টি ব্রিজ এবং কয়েকটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পের ৬ কি.মি. রাস্তা নির্মাণে কাটা হয় ১৬টি পাহাড়। একেবারে নতুন রাস্তাটি নির্মাণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আড়াই লাখ ঘনফুট পাহাড় কাটার অনুমোদন নিয়ে সিডিএ ১০ লাখ ৩০ হাজার ঘনফুট পাহাড় কাটে। প্রকল্প প্রস্তাবনায় যত ঘনফুট পাহাড় কাটার অনুমোদন নিয়েছিল বাস্তবে তার থেকে ৬৯ হাজার ২১৯ দশমিক ৭০২ বর্গফুট বেশি কাটা হয় বলে জানায় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শনকারী টিম।
এরপর ২৯ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরে ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়ে শুনানিতে তলব করে সিডিএকে। শুনানিতে পাহাড় কেটে জীববৈচিত্র ধ্বংস, পাহাড়ের উপরিভাগের মাটি এবং ভূমির বাইন্ডিং ক্যাপাসিটি নষ্টসহ পরিবেশ-প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করার অভিযোগ আনা হয়। শুনানি শেষে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার ৫৫৩ টাকা জরিমানা নির্ধারণ করেন অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) রুবিনা ফেরদৌসী। এরপর ১৩ ফেব্রুয়ারি আরেক শুনানিতে ওই প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডকেও ৫ কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এরমধ্যে ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক ড. এ কে এম রফিকুল ইসলাম প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে অনুমোদনের বাইরে পাহাড় কাটার প্রমাণ পান। পরবর্তীতে ৬ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নকশা না মেনে পাহাড় কাটার অভিযোগ তুলেন সিডিএর বিরুদ্ধে।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের চাপের মুখে নতুন করে পাহার কাটার জন্য অনুমোদন চেয়ে আবেদন করে সিডিএ। প্রকল্পে আগে কাটা ১৬টি পাহাড় ২২.৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে কাটার প্রস্তাবনা দিলেও পরিবেশ অধিদপ্তর না করে দেন। পরে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অনুমোদন চাওয়া হলেও ২২.৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে পাহাড় কাটার সম্মতি মেলেনি। পরবর্তীতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো কাটা ও সংরক্ষণ কিভাবে করা হবে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতসহ প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। বর্তমানে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলীর নেতৃত্বে প্রকল্প পরিচালক ও চুয়েটের দুই শিক্ষকের সমন্বয়ে চার সদস্যের কমিটি কাজ করছে। বুয়েটের দুই শিক্ষক ইতোমধ্যে পাহাড়গুলো পর্যবেক্ষণ করেছেন। তবে এখনো প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেনি ওই কমিটি। কমিটির প্রতিবেদন জমা দিলেও পরিবেশ অধিদপ্তর যদি সম্মতিসহ নির্দেশনা দেয়, তাহলেই পাহাড়গুলো কাটার পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস।
তিনি গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বায়েজিদ লিংক রোডের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো কাটার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড়গুলোর কাটার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন চেয়েছে। ইতোমধ্যে চার সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। আমি কমিটির প্রধান হিসেবে রয়েছি। কমিটিতে প্রকল্প পরিচালক ও চুয়েটের দুই বিশেষজ্ঞ রয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘কিভাবে পাহাড়গুলো কাটা যাবে এবং সংরক্ষণ করা হবে, সে বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী কমিটিতে থাকা চুয়েটের দুই বিশেষজ্ঞ দিয়ে আমরা পাহাড়গুলো সার্ভে করাচ্ছি। দুই বিশেষজ্ঞের প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে নতুন প্রস্তাবনা দেওয়া হবে পরিবেশ অধিদপ্তরে।’
সিডিএর এই প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘১৬টি পাহাড়ের মধ্যে ৪-৫টি পাহাড় বালিযুক্ত হওয়াতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলোতে ইতোমধ্যে ধস শুরু হয়েছে। সতর্কতার জন্য আমরা ওই পাহাড়ের পাশে সড়কের কিছু অংশে একপাশ যানবাহন চলাচলের জন্য বন্ধ করে দিয়েছি। তাছাড়া বেশি ঝুঁকিপূর্ণ যে কয়টি পাহাড় রয়েছে সেগুলো ওম্যান ইউনিভার্সিটির মালিকানাধীন। পাহাড়গুলো কাটার বিষয়ে ওম্যান ইউনিভার্সিটির সাথে কথা বলেছি, তাদেরও সম্মতি রয়েছে। এখন পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি পেলেই আমরা পাহাড়গুলো কাটব, রিটেনিং ওয়াল করব। আশা করছি এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি আমরা শেষ করে দেব।’