করোনা সংক্রমণ রোধে দেশব্যাপী চলছে লকডাউন। এর অংশ হিসেবে খাগড়াছড়িতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে প্রশাসন। ফলে জেলায় যান চলাচল ও দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। পাহাড়জুড়ে সুনসান নিরবতা। পাহাড়ি বাজারগুলোতে কেনা বেচা। পর্যটক নেই পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে। লকডাউনে এরকম স্থবির হয়ে পড়েছে কৃষি ভিত্তিক পাহাড়ি অর্থনীতিও। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে এই এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। কাজ হারিয়েছেন জেলা-উপজেলার দিনমজুর, শ্রমিক, ভাড়ায় চালিত বাইক চালক ও পর্যটনসহ বিভিন্ন পরিবহন খাতের শ্রমিকরা।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার দুর্গম তৈদু পাড়ার বাসিন্দা হিরণময় ত্রিপুরা। চার সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। এবার জুমে হলুদ আবাদ করেছেন তিনি। ফলনও ভালো হয়েছে। তবে লকডাউনে তা বিক্রি করতে পারছে না। বন্ধ হয়ে গেছে আয়ের একমাত্র পথ। তিনি বলেন, আগে সাপ্তাহিক হাটের দিন পাড়া থেকে বাজারে যাওয়ার জন্য গাড়ি আসত। লকডাউনের কারণে এখন আসে না। পাড়ার কৃষক বা চাষি যারা রয়েছেন তারা কেউ বাজারে হলুদ, আদা, ফুলঝাড়ুসহ বিভিন্ন কৃষি ও বনজ পণ্য বাজারে নিয়ে যেতে পারছেন না। এভাবে চলতে থাকলে পাড়ার ৩২ পরিবারের উপার্জনের কোনো পথ থাকবে না। একই পাড়ার বাসিন্দা উজ্জ্বল কান্তি ত্রিপুরা। তিনি জানান, লকডাউনের পর থেকে আমাদের কোনো আয় রোজগার নেই। পাড়া থেকে বাজারে যাওয়ার পয়সাও নেই। শুনেছি বাজারে মানুষজনও কমে গেছে। বেপারিরাও আসতে পারছেন না। আশপাশের কয়েকটি পাড়ার একই অবস্থা। উপজেলা সদর থেকে তৈদুপাড়ার দূরত্ব প্রায় ২০ কিমি। সরাসরি সড়ক যোগাযোগও নেই। পায়ে হেঁটে মাথায় বোঝাই করে এত মালামাল বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব না। আগের লকডাউনে সরকারিভাবে ত্রাণ সহায়তা পেলেও এবার তা কেউ পাচ্ছেন না। এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজন। তাদের দাবি, এই দুঃসময়ে যেন তাদের আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। ত্রাণ সহায়তার বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্য গণেশ কান্তি ত্রিপুরা বলেন, ডকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে স্থানীয় লোকজন ত্রাণ দেওয়ার জন্য বলছেন। কিন্ত এখনো বরাদ্দ না পাওয়ায় কোনো সহায়তা দিতে পারিনি। কয়েকদিন আগে চেয়ারম্যান ২২ জনের তালিকা দিতে বলেছিলেন। তালিকা জমা দিয়েছি কিন্ত এখনো কোনো সহায়তা পাইনি।
খাগড়াছড়ি থেকে রাঙামাটির লংগদু পর্যন্ত ভাড়ায় বাইক চালিয়ে ৫ জনের সংসারের ভরণ পোষণ করেন কানু চন্দ্র শর্মা। তিনি জানান, লকডাউনের প্রথম কয়েকদিন মোবাইল কোর্ট ও পুলিশের ভয়ে গাড়ি বের করার সাহস পাইনি। কিন্ত এখন বের না করে উপায় নেই। পুলিশের ভয় মাথায় নিয়ে ভাড়ার খোঁজে ঘর থেকে বেরিয়েছি। কিন্ত রাস্তায় যাত্রী সংখ্যা কমে গেছে। আগে প্রতিদিন আয় হত অন্তত এক থেকে দেড় হাজার টাকা। এখন সারাদিনে মাত্র সাড়ে তিনশ টাকা আয় করতে পেরেছি। এটা দিয়ে কিভাবে সংসার চলবে?
খাগড়াছড়ি জেলা সদরের আব্দুল কাইয়ুম পেশায় ইজিবাইক চালক। তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৮ জন। নিজের ইজিবাইক নিয়ে লকডাউনের মাঝেও ঘর থেকে বের হয়েছেন। তিনি বলেন, এটাই একমাত্র পেশা। গত ৪ দিন গাড়ি বের করিনি। কিন্ত বাসায় খাওয়ার কিছু নেই। লকডাউনের কারণে বাজারে মানুষ কমে গেছে। এখন ভাড়াও কম। যাত্রী পরিবহন করার সময় পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ধরা পড়লে জরিমানা গুণতে হয়। তারপরেও বিকল্প উপায় না পেয়ে ঘর থেকে বের হয়েছি।
লকডাউনের পর থেকে খাগড়াছড়ি বাজারে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন মালামাল উঠা নামার কাছে নিয়োজিত প্রায় ৩০ জন শ্রমিক। তাদের মধ্যে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, একদিন কাজ থাকলে তিন দিন থাকে না। আগে দিনে ৪শ থেকে ৫শ টাকা আয় হত। কিন্তু এখন কমে গেছে।
খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী জানান, আমরা সরকারে কাছ থেকে এখনো কোনো ত্রাণ সহায়তা পাইনি। সরকারিভাবে বরাদ্দ পেলে কর্মহীন মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করব।
দীঘিনালা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. কাশেম জানান, আমরা সরকারি কোনো ত্রাণ সহায়তা না পেলেও করোনা প্রতিরোধে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান বিতরণের জন্য বরাদ্দ পেয়েছি। এসব সুরক্ষা সামগ্রী চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস জানান, যদি লকডাউনের সময়সীমা বাড়ে সেক্ষেত্রে ত্রাণের ব্যবস্থা করা হবে। আমরা সরকারি ভাবে এখনো কোনো ত্রাণ বিতরণের নির্দেশনা পাইনি। নির্দেশনা পাওয়ার পর ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হবে।












