কবরীকে হারানোর শোকের মধ্যেই পরপর আরো দুটি দুঃসংবাদ দেশের অভিনয় জগতে। এবার চলে গেলেন সত্তর ও আশির দশকের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ও প্রযোজক মেজবাহ উদ্দীন আহমেদ ওয়াসীম(৭৪) ও একুশে পদকপ্রাপ্ত মঞ্চ ও টেলিভিশন অভিনেতা এস এম মহসীন (৭৩)। শনিবার দিনগত রাত ১২টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর শাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ওয়াসীম আর গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ৯টায় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এস এম মহসীন (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)।
ওয়াসীম দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস, হৃদযন্ত্র ও কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে শনিবার রাতে তাকে শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান জানান, এ অভিনেতা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন না। আর অন্যদিকে করোনায় মারা গেলেন অভিনেতা এস এম মহসীন। পাবনায় ওয়াজেদ আলী সুমন পরিচালিত ও শাকিব খান অভিনীত ‘অন্তরাত্মা’ সিনেমার শুটিং সম্পন্ন করে গত ২ এপ্রিল ঢাকায় ফেরেন এস এম মহসীন। এরপর থেকে তার করোনার উপসর্গ দেখা দিলে তাকে প্রথমে একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখান থেকে পরবর্তীতে ইমপালস হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে বারডেম হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। তবে শেষ চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে গতকাল পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন তিনি।
সত্তর ও আশির দশকজুড়ে ফোক ফ্যান্টাসি ও অ্যাকশন চলচ্চিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছিলেন ওয়াসীম। সেই সময়ে শীর্ষ নায়কের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি। তার অভিনীত দেড় শতাধিক চলচ্চিত্রের মধ্যে বেশিরভাগই সুপারহিট ছবি। ১৯৭২ সালে সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরুর পর ১৯৭৪ সালে মহসিনের পরিচালনায় ‘রাতের পর দিন’ সিনেমার মাধ্যমে নায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটে ওয়াসীমের। প্রথম ছবিতেই দর্শকদের নজর কেড়ে কয়েক বছরের ব্যবধানেই ঢালিউডে নিজেকে শীর্ষস্থানে নিয়েছেন তিনি। এস এম শফীর পরিচালনায় ‘দ্য রেইন’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে দর্শদের পাশাপাশি বোদ্ধামহলেও প্রশংসিত হয়েছিলেন ওয়াসীম। ছবিটি বিশ্বের ৪৭টি দেশে মুক্তি পেয়েছিল। ‘দ্য রেইন’ ছাড়াও দুই দশকের ক্যারিয়ারে ‘ডাকু মনসুর’, ‘জিঘাংসা’, ‘কে আসল কে নকল’, ‘বাহাদুর’, ‘দোস্ত দুশমন’, ‘মানসী’, ‘দুই রাজকুমার’, ‘সওদাগর’, ‘নরম গরম’, ‘আসামি হাজির’, ‘রাজ দুলারী’, ‘লুটেরা’, ‘লাল মেম সাহেব’, ‘জীবন সাথী’, ‘রাজমহল’, ‘বিনি সুতার মালা’, ‘বানজারান’র মতো হিট চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন ওয়াসীম। নায়িকাদের মধ্যে অলিভিয়া, রোজিনা, অঞ্জু ঘোষ, কবরী, শাবানার সঙ্গে সর্বাধিক চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন তিনি।
অভিনয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন ওয়াসীম। নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ডব্লিউ আর প্রোডাকশনে ব্যানারে নির্মাণ করেছেন ‘হিসাব চাই’, ‘মোহন বাঁশি’, ‘নয়া তুফানসহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র। ১৯৬৪ সালে বডি বিল্ডিংয়ের জন্য ‘মিস্টার ইস্ট পাকিস্তান’ খেতাব অর্জন করেছিলেন ওয়াসিম।
ব্যক্তিগত জীবনে অভিনেত্রী রোজী আফসারীর ভগ্নিপতি ও পরিচালক মালেক আফসারীর ভায়রা ওয়াসিম দুই সন্তানের জনক। তার স্ত্রী ২০০০ সালে মারা গেছেন। মেয়ে বুশরা আহমেদ ২০০৬ সালে আত্মহত্যা করেছেন। একমাত্র ছেলে দেওয়ান ফারদিন আইন পেশায় নিয়োজিত আছেন। ১৯৪৭ সালের ২৩ মার্চ চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন ওয়াসীম। গতকাল রোববার জোহরের পর গুলশানের আজাদ মসজিদে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে ওয়াসীমকে সমাহিত করা হয়।
এস এম মহসীনের জন্ম টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার আনাইতারা ইউনিয়নের খাগুটিয়া গ্রামে। প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে অভিনয় করে যাচ্ছেন তিনি। আতিকুল হক চৌধুরী পরিচালিত ‘রক্তে ভেজা’ ও ‘কবর’ নাটকে এবং মুনীর চৌধুরী পরিচালিত ‘চিঠি’ নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। পদক্ষেপ নামক নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি রেডিও নাটকে আত্মপ্রকাশ করেন। একই সঙ্গে থিয়েটার দল ড্রামা সার্কেলেও অভিনয় করেছেন এই প্রবীণ অভিনেতা। মঞ্চ ও টেলিভিশনের পাশাপাশি এস এম মহসীন বেশকিছু সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন।
এস এম মহসীন দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন শিল্পকলা একাডেমিতে। পাশাপাশি শিক্ষকতাও করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো লাভ করেন তিনি। অভিনয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০২০ সালে একুশে পদকে ভূষিত করে।