কিংবদন্তী অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাবেক সাংসদ সারাহ বেগম কবরীর কফিনে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন দীর্ঘদিনের সহকর্মী, রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা; গতকাল শনিবার জোহরের পর বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে তাকে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার রাতে মারা গেছেন কবরী। খবর বিডিনিউজের।
শনিবার দুপুরে গুলশানের বাসা থেকে তার মরদেহ দুপুরে বনানী কবরস্থান প্রাঙ্গণে নেওয়া হয়। দুপুর একটায় তাকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করা হয়; এরপর নানা শ্রেণিপেশার মানুষ তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজারের আলো-হাওয়ায় বেড়ে উঠা কিশোরী মিনা পাল ষাটের দশকে নির্মাতা সুভাষ দত্তের হাত ধরে ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রে নায়িকা হিসেবে আবির্ভূত হন; ভীরু ডাগর চোখের কবরীর ভ্রু’র তালে উত্তাল হয়েছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। দীর্ঘ পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে ক্যামেরার ফ্রেম থেকে ফ্রেমে আপন ছায়া ফেলে গেছেন কবরী; ক্যারিয়ারজুড়ে সমসাময়িক অভিনয়শিল্পীদের তুলনায় নিজেকে অনন্য ছিলেন ঢাকাই চলচ্চিত্রে ‘মিষ্টি মেয়ে’।
শেষ বারের মতো কবরীকে শ্রদ্ধা জানাতে এসে চলচ্চিত্র পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজারও তেমনটায় বলছিলেন। তিনি বলেন, কবরী আপা বাংলাদেশে ক্ষণজন্মা একজন অভিনয়শিল্পী। তার মতো অভিনেত্রী এই দেশে পাওয়া বিরল। এখনও মানুষ তাকে গর্ব করে ‘মিষ্টি মেয়ে’ বলেন; এটা অভিনয়শিল্পী হিসেবে তার অনেক বড় পাওয়া।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে কবরী যখন ঢাকার চলচ্চিত্রে পা ফেললেন তখন শবনম ছিলেন ঢাকাই চলচ্চিত্রে শীর্ষ নায়িকা; তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন সুজাতাও। বাঘা বাঘা নায়িকাদের ভিড়ে কিশোরী কবরী কিভাবে অনন্য হয়ে উঠলেন? গুলজার বললেন, কবরী আপা সব ধরনের চরিত্রে মানানসই অভিনেত্রী ছিলেন। রোমান্টিক চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন, দুষ্টুমিভরা খেয়ালিপনা চরিত্রে অসাধারণ কাজ করেছেন। আবার যখন সাধারণের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তখনও অসাধারণ করেছেন। গ্রাম বাংলার চরিত্রে পাশাপাশি শহরকেন্দ্রিক চরিত্রেও তিনি পারফেক্ট ছিলেন। কখনও কাউকে আরবান ইমেজে পাই, কখনো ভিলেজ ইমেজে পাই। সব দিক দিয়ে কবরী আপা অনন্য অভিনেত্রী।
‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রে একজন গর্ভবতী নারীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কিশোর কবরী। বিডিনিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কবরী বলেছিলেন কিভাবে সেই চরিত্রে নিজেকে শাণিত করেছেন।
‘পরিচালক যখন কোনো চিত্রনাট্য বুঝিয়ে দেন সেটা ভালোভাবে রপ্ত করি। একেবারে সাধারণের সঙ্গে যে মিশি না তা কিন্তু নয়; আমাদের বাড়ির কাজের মেয়েকে দেখি। ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রে গর্ভবতী নারীর চরিত্রে অভিনয় করেছি। বাচ্চা হলে পেট ব্যথা করে কি না সেটাও তখন জানতাম না। সেটা মায়ের কাছ থেকে শিখেছি।’
অভিনয়শিল্পী হিসেবে কবরীর কিংবদন্তী হয়ে উঠার পেছনে তার সহজাত অভিনয়কেই এগিয়ে রাখছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান। কবরী অভিনীত ‘কলমিলতা’ চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন সোহান।
শেষ বারের মতো কবরীকে দেখেতে এসে সোহান বলেন, তার মতো আসলে কেউই না। আজই কবরী আপার একটা গান দেখছিলাম। গানটা অন্য কেউ গেয়েছে সেটা আমার কাছে মনে হয়নি। মনে হয়েছে, কবরী আপা নিজেই গানটি গেয়েছেন। গানের প্রতিটা বিটে বিটে এক্সপ্রেশন দিয়ে তিনি যে আবেগটা তৈরি করতেন সেটা আর কেউ পারেনি। সেটা আর কখনও পারবে বলে আর আমার জানা নেই।
পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে কবরীর সবচেয়ে রঙিন সময় কেটেছে লাল দালানের এফডিসিতে; শিল্পী সমিতি কিংবা পরিচালক সমিতি প্রাঙ্গণে জমিয়ে আড্ডা দিতেন কবরী। স্বাস্থ্যবিধি বিবেচনায় চিরচেনা সেই স্মৃতিবিজড়িত এফডিসিতে শেষবারের মতো নেওয়া হয়নি তাকে।
কবরীকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাতে বনানী কবরস্থানে এসেছিলেন শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান। মিশা সওদাগর সাংবাদিকদের বলেন, কবরী আপাকে সম্মানিত করার জন্য ফিল্ম আর্কাইভ রাজ্জাক ভাই ও কবরী আপার নামে উৎসর্গ করার দাবি জানাই। সেই সঙ্গে এফডিসিতে রাজ্জাক ভাই ও কবরী আপার নামে একটি ফ্লোর করা হোক।
কবরীর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্রগুলোর বেশিরভাগই নায়ক ছিলেন রাজ্জাক। উপমহাদেশের বাঙালিদের কাছে জুটি হিসেবে উত্তম-সুচিত্রার জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া তখনই বাঙালির চিরায়ত জুটিতে পরিণত হয়েছিলেন রাজ্জাক-কবরী।
২০১৭ সালে এক প্রস্থানের মধ্য দিয়ে চিরায়ত জুটির বিচ্ছেদ ঘটলেও তার পাঁচ বছর বাদে আরেক প্রস্থানে স্বর্গেই যেন জুটি বাঁধলেন তারা। কাকতালীয় হলেও বনানী কবরস্থানে কবরীকে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে তার অদূরেই চিরঘুমে আছেন রাজ্জাকও! অন্যান্য নায়কদের মধ্যে আলমগীর, ফারুক, জাফর ইকবাল, উজ্জ্বল ও সোহেল রানাদের চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটেছে কবরীর বিপরীতে; জাফর ইকবাল বেশ আগেই গত হয়েছেন। বাকিদের মধ্যে ‘সখি’ ববিতার ‘সুজন’ নায়ক ফারুক গুরুতর অসুস্থ; সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে আইসিইউতে আছেন। বাকিরা স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় তাকে দেখতে আসতে পারেননি।
১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে জন্ম নেওয়া মিনা পালের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারে। ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, কিংবা পরে ‘সুজন সখী’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘সারেং বউ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’র মতো দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন কবরী।
তারুণ্যের সেই দিনগুলোতেই এল বাঙালির ইতিহাস বদলে দেওয়া একাত্তর। অভিনেত্রী কবরী কলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেখানে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেন। পরে দেশে ফিরে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন সিনেমায়।
সেলুলয়েডের সেই রঙিন জীবন শেষে কবরীর পরের জীবন-চলচ্চিত্রও কম বর্ণময় ছিল না। রাজনীতিতে নেমে জীবনের আরেক চলচ্চিত্রের মুখোমুখি তাকে হতে হয়েছিল বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে। এক সময় নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের বধূ কবরীকে ভোটের মাঠে সেই নারায়ণগঞ্জেই নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সব জয় করেই ২০০৮ নবম সংসদে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ হয়েছিলেন তিনি।
২০০৬ সালে মুক্তি পায় কবরীর পরিচালার প্রথম চলচ্চিত্র ‘আয়না’। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবেও যোগ দিয়েছিলেন। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে সরকারি অনুদানে ‘এই তুমি সেই তুমি’ নামে দ্বিতীয় চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন তিনি। সে কাজ আর তার শেষ হল না।