আজ থেকে শুরু হচ্ছে কঠোর লকডাউন। কাজ থাকবে না কারো। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবীদের বেতন চললেও নানা পেশার কর্মহীন মানুষের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। কাজ না থাকলে পেটের খাবার যোগাড় দায় হয়ে পড়বে তাদের। শুধু নিজে নয়; পরিবারের অন্য দশ সদস্যের অন্নের যোগানও অনিশ্চয়তায় পড়বে। লকডাউনে নগরীতে আটকে পড়ার ভয়ে দলবেঁধে বাড়ি ফিরছে মানুষ। যান্ত্রিক এ শহরে না খেয়ে দিন কাটানোর চেয়ে গ্রামের বাড়িকেই নিরাপদ মনে করছেন কমবেশি সবাই। অন্যবছরগুলোতে রোজা ও কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে মানুষজন নগরী ছাড়লেও করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে এবারের চিত্র একেবারে ভিন্ন।
অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়ে নগরী ছেড়েছে কম আয়ের মানুষজন। আবার লকডাউন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, এ সুযোগে পরিবার পরিজন নিয়ে বাড়িতে গেছেন অনেক চাকুরিজীবী। যে কারণে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে ছিল ঘরমুখো মানুষের ঢল। সংকট তৈরি হয় দুরপাল্লার বাসের। বাড়তি ভাড়ার পাশাপাশি সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের। এছাড়া অভিযোগ ছিল স্বাস্থ্যবিধি না মানার। বাসে দ্বিগুণ যাত্রীর পাশাপাশি গুণতে হয়েছে তিন চারগুণ ভাড়া। বাস না পেয়ে অনেকে ট্রাক, কার, মাইক্রোবাস এমনকি মোটরবাইকে চড়ে গন্তব্যে গেছেন।
গতকাল সকাল থেকে নগরীর প্রবেশমুখগুলো লোকে লোকারণ্য ছিল। অলংকার, সিটি গেইট, অঙিজেন, মুরাদপুর, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, নতুন ব্রিজের বাসস্ট্যান্ডগুলোতে চোখে পড়েছে মানুষের অসহনীয় দুর্ভোগের চিত্র। স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে অনীহা ছিল ঘুরমুখো বেশিরভাগ মানুষের। অনেকে ন্যূনতম মাস্কও পরেননি। অনেকে মাস্ক থুতনির সাথে ঝুলিয়ে রেখেছেন।
বিকেল তিনটায় সিটি গেইট এলাকায় বাস না পেয়ে কিছু লোক দৌড়ে খোলা ট্রাকে চড়ে বসেন। খোলা ট্রাকটির গন্তব্য পাশের জেলা ফেনী। ট্রাকটিতে চড়ে বসা ফেনীর ছাগলনাইয়া এলাকার বাসিন্দা জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘একটি ব্যক্তিগত কাজে এসেছিলাম। কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছি। কিন্তু সিটি গেইট এসে কোনো বাস পাচ্ছি না। তাই বাধ্য হয়ে ট্রাকে চড়েছি। আমরা ২০ জন মতো যাত্রী উঠেছি। প্রতিজন ৩শ টাকা করে।’ জিয়াউদ্দিনের মতো সিটি গেইট এলাকা থেকে ট্রাক বাদেও বেশি ভাড়ায় হাইচ ও প্রাইভেট কারে চড়েছেন অনেকে। তবে পরিবার পরিজন নিয়ে আসা লোকজনের ভোগান্তি ছিল বেশি।
সিটি গেইটের পাশাপাশি অলংকার মোড় এলাকা থেকেও চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়ক হয়ে অনেক গন্তব্যে ছেড়ে গেছে যাত্রীবাহী বাস। তবে যাত্রীর তুলনায় বাসের সংখ্যা ছিল নগন্য। এ সুযোগে বাড়তি আদায় করেছেন তারা। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী ফিরছেন নেয়ামুল ইসলাম। বাস না পেয়ে একপ্রকার বাধ্য হয়েই ফেনী পর্যন্ত মাইক্রোবাসে উঠেছেন তিনি। নেয়ামুল বলেন, এখন বাস পাচ্ছি না। প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে মাইক্রোটি পেয়েছি। আমার চারজনের জন্য তিনসিট দেড় হাজার টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে। ফেনী গিয়ে অন্য গাড়ি করে বেগমগঞ্জ যেতে হবে।
এদিকে দুপুর থেকে নগরীর নতুন ব্রিজে কঙবাজার, বান্দরবানসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন রুটের যাত্রীদের ভীড়। মন্ত্রণালয় থেকে অর্ধেক যাত্রী ৬০ শতাংশ বর্ধিত ভাড়া ঘোষনার পরও বেশিরভাগ গণপরিবহন দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়ার পাশাপাশি যাত্রী নিচ্ছেন ইচ্ছেমতো। মঙ্গলবার নতুন ব্রিজ থেকে অনেক গাড়ি যাত্রী বোঝাই হয়ে কাছাকাছি গন্তব্যে। ‘জ্যামফিট’ উল্লেখ করে যাত্রী নিয়েছেন অনেক বাস। সরকারি স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করলেও নতুন ব্রিজে মঙ্গলবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রশাসনের কোনো নজরদারি চোখে পড়েনি। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন রুটে ২০ টাকার ভাড়া ৫০ থেকে ১০০ টাকা। ৫০-৮০ টাকার ভাড়া ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করেছে পরিবহনের চালক-হেলপাররা। সন্ধ্যার পর বাস কমে যাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে আরও বেশি। অনেকে বাধ্য হয়ে ট্রাক, পিকআপেও চড়েছেন বেশি ভাড়ায়।
নগরীর অঙিজেন মোড় এলাকা থেকে ছেড়ে গেছে উত্তরের উপজেলা রাউজান, হাটহাজারী, ফটিকছড়ির বাসগুলো। একইসাথে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ছেড়ে গেছে অনেক বাস। প্রায় সব বাসেই স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি। ভাড়াও নেওয়া হয়েছে সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশি। অন্যদিকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়া, গোমদন্ডী, বেঙ্গুরাগামী যাত্রীদের কাছ থেকেও কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আদায় করেছে ওই রুটের টেম্পু ও চট্টগ্রাম নিবন্ধিত সিএনজি অটোরিকশাগুলো।
এদিকে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণে দ্বিতীয় দফায় সরকার ৫ এপ্রিল থেকে ৭ দিনের লকডাউন ঘোষণা করে। তবে শিল্পকারখানা, অফিস আদালত, ব্যাংক, গণপরিবহন খোলা রাখে। পরে ব্যবসায়ী কর্মচারীদের বিক্ষোভ ও দাবির মুখে দোকানপাটও খোলা রাখার ঘোষণা আসে। এতে লকডাউনের সুফল মেলেনি। পরবর্তীতে ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউনের ঘোষণা আসে। এর ফলে নগরী ছাড়ে অসংখ্য মানুষ।
চট্টগ্রাম কঙবাজার বিলাসী কোস্টার চেয়ারকোচ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান চৌধুরী মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘সরকার সব গণপরিবহন বন্ধ করে দিলে আমাদের কোনো সমস্যা ছিল না। গত সপ্তাহের লকডাউনে কিছু খোলা রেখেছে, কিছু বন্ধ রেখেছে। পথিমধ্যে লোকজনের চাপে অনেকে রাস্তায় বাস নামিয়েছে। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ আমাদের অনেক বাসকে মামলা দিয়েছে, টো করেছে। একটি বাসে একদিনে দুই হাজার টাকা আয় হয় না। কিন্তু মামলাগুলোর জরিমানা এসেছে ৮-১১ হাজার টাকা পর্যন্ত।’ তিনি বলেন, ‘বুধবার থেকে কঠোর লকডাউন শুরু হচ্ছে। মানুষজন হুমড়ি খেয়ে বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। বাস ছাড়তে না চাইলেও যাত্রীরা বাধ্য করে গাড়িতে উঠে বসেছেন। পরে বাস না থাকায় ১০ হাজার টাকায় মাইক্রো ভাড়া করেও লোকজন বাড়িতে গেছে। যাত্রীরা নিজেরাই স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। অনেকে সিট না পেয়ে জোর করেই দাঁড়িয়ে বাসে উঠে গেছে।’