এবারও অন্যরকম রমজান

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১৩ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

আসছে পবিত্র রমজান মাস। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় এবার সিয়াম-সাধনার মাসটি অন্যভাবে পালন করবেন মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা। রমজান মাসের চিরায়ত ঐতিহ্য ইফতার মহফিল এবং মসজিদে খতমে তারাবিহ আদায়। থাকে সাধারণ রোজাদারের জন্য মসজিদে মসজিদে ইফতারের আয়োজনও। মাসটিতে মুসল্লিদের চেষ্টা থাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে আদায়েরও। কিন্তু এবার সব আয়োজনে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠেছে করোনাভাইরাস। ফলে অন্য এক রমজান মাস পালন করা হবে এবার। তবে ঘরে ঘরে সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা।
মুসলমানদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত মাস রমজান। পবিত্র কোরান নাজিল হয়েছিল এ মাসে। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজান। সূর্যোদয়ের আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকেন রোজাদাররা। মধ্যরাতে সেহরি খাওয়ার পর সূর্য ডোবার সময় ইফতার করবেন তারা। এক্ষেত্রে মসজিদে মসজিদে আয়োজন করা হতো ইফতার। জামায়াতে এশার নামাজ শেষে তারাবিহ আদায়। সবকিছুই এবার থমকে গেছে।
খতমে তারাবিহ ও মসজিদে ইফতার : করোনা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় সরকারি নির্দেশনার আলোকে মসজিদে ২০ জনের অধিক মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন না। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে খতমে তারাবিহ আয়োজনের বিষয়টি। অবশ্য বেশিরভাগ মসজিদ কর্তৃপক্ষ খতমে তারাবিহ পড়ার জন্য কোরআনে হাফেজ ঠিক করে ফেলেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত খতমে তরাবিহ নাকি সূরা তারাবিহ হবে তা আজকে সিদ্ধান্ত নেবেন মসজিদ পরিচালনা কমিটি। তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালিত জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে খতমে তারাবিহ হবে না। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকারি নির্দেশনার আলোকে সূরা তারাবিহ আদায় করা হবে।
ইসলামি স্কলাররা বলছেন, খতমে তারাবিহ জামাত সহকারে আদায় করা সুন্নাতে কেফায়া। তাই সম্ভব হলে, ঘরে পিতা-পুত্র কয়েকজন মিলে সূরা তারাবির মাধ্যমে জামাত সহকারে তারাবিহ আদায় করা যায়। আর যদি একেবারে সেটিও সম্ভব না হয় তাহলে একাকি কোরআন শরীফের ছোট ছোট সূরার মাধ্যমে তারাবিহ নামাজ আদায় করবেন। প্রতিবছর নগরীর জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ, আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, ষোলশহর আলমগীর খানকাহ শরীফ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণহ ছোট-বড় প্রায় মসজিদে প্রতিদিন শত শত মানুষ ইফতার করতেন একসঙ্গে। যা এবার হচ্ছে না।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন চট্টগ্রামের পরিচালক বোরহান উদ্দিন মো. আবু আহসান দৈনিক আজাদীকে বলেন, সব মসজিদ আমাদের কন্ট্রোলে নেই, যেগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে সেখানে আমরা সরকারি নির্দেশনা শতভাগ বাস্তবায়ন করব। অন্যান্য মসজিদগুলোতে আমরা সরকারি বার্তা পৌঁছে দিবে। আমরা তাদের উদ্বুদ্ধ করব। তবে সরকারি নির্দেশনা মানা হচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করবে প্রশাসন।
খতমে তারাবিহ হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, খতম বা সূরা তারাবিহ যেটাই হোক না কেন ২০ জনের বেশি মুসল্লি থাকবে না। মসজিদের ইমাম, খতিবসহ নিজস্ব লোক ১০ জনের মতো এবং বাকিগুলো মুসল্লিদের মধ্যে থেকে বাছাই করা হবে। স্থানীয় কিছু মুসল্লি আছেন যারা পাঁচওয়াক্ত নামাজ মসজিদে আদায় করেন। তাদের মধ্যে থেকে বাছাই করব। স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি নিশ্চিতের চেষ্টা থাকবে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালিত জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ কমপ্লেক্সের প্রকল্প পরিচালক মো. ইদ্রিছ দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রতিবছর ২০০-২২৫ মানুষের ইফতার ও সেহেরির আয়োজন করা হতো জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ কমপ্লেঙে। এবার সেটা হবে না। তবে খতমে তারাবির জন্য পূর্ব নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সবধরনের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। হাফেজও ঠিক করেছিলাম। এখন যেহেতু নতুন করে ২০ জন মুসল্লির বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত দিয়েছে সেক্ষেত্রে খতমে তারাবিহ হবে না। সূরা তারাবিহ হবে। করোনার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে মুসল্লিদের শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিতে তারা কোথায় দাঁড়াবেন সেটা রং দিয়ে মার্ক করে দিয়েছি। যারা আসবেন সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। সরকারের সব নির্দেশনা মানতে হবে। চট্টগ্রামের অন্যান্য মসজিদ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেসরকারিভাবে যেসব মসজিদ পরিচালিত হয় তাদেরকে সরকারি নির্দেশনা মানতে হবে। অন্যথায় প্রশাসন ব্যবস্থা নিবে।
জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের খতিব ও জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসার মুহাদ্দিস আল্লামা সৈয়দ আবু তালেব মোহাম্মদ আলাউদ্দীন আল কাদেরি আজাদীকে বলেন, করোনার জন্য গত বছরও খতমে তারাবিহ হয়নি। এবার দুজন হাফেজ প্রস্তুত আছেন। তবে তাদের বলা আছে, শেষ পর্যন্ত সরকার যে নির্দেশনা দিবে সেটা বাস্তবায়ন করা হবে।
আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছর ষোলশহরস্থ আলমগীর খানকাহ্‌-এ-কাদেরিয়ার সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়ায় পবিত্র রমজানুল মোবারক উপলক্ষে ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু গত বছরের চেয়ে এবছরেও কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং সরকারে বিধিনিষেধ আরোপিত থাকায় এবার আলমগীর খানকাহ্‌ শরীফে কোনো ইফতারের আয়োজন করা হবে না। খতমে তারাবির আয়োজন করা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া জামে মসজিদে পবিত্র খতমে তারাবিহ অনুষ্ঠিত হবে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা হবে।
এর আগে গত ৯ এপ্রিল স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দায়েম নাজির জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া জামে মসজিদের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন চৌধুরী ও সেক্রেটারি মোহাম্মদ সিরাজুল হক বলেন, ‘তিনজন কোরআন হাফেজ দ্বারা প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও ষোলশহরস্থ দায়েম নাজির জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া জামে মসজিদে পবিত্র খতমে তারাবিহ অনুষ্ঠিত হবে। এতে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক নিজ নিজ বাসা থেকে ওযু করে সুন্নাত আদায় করে আসতে হবে। মসজিদে মাস্ক পরিধান করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে খতমে তারাবির আদায়ের জন্য নিজ নিজ জায়নামাজ সাথে নিয়ে আসতে হবে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ওমর ফারুক আজাদীকে বলেন, নামাজের বিষয়ে সেন্ট্রালি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেটা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করা হবে।
হবে না ইফতার মাহফিল : বারকোড রেস্টুরেন্ট গ্রুপের কর্ণধার মনজুরুল হক আজাদীকে বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা এখন আইসিইউতে। সেখান থেকে ফিরবে কিনা একমাত্র আল্লাহ জানেন। শুধু বারকোড না, সব রেস্টুরেন্টের একই অবস্থা। গতবার যখন সাধারণ ছুটি ছিল তখন থেকেই রেস্টুরেন্ট ব্যবসা খুব খারাপ অবস্থায় আছে। এবার যে লকডাউন তা আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। সরকারি নির্দেশনার আলোকে রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার সুযোগ নেই। তবে হোম ডেলিভারি সার্ভিস চালু থাকবে। এক্ষেত্রে সরকার যে সময় নির্ধারণ করেছে সেটা নিয়েও আমরা কনফিউজ। হোম ডেলিভারির জন্য দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা এবং রাত ১২টা ভোর ৬টা পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে। রমজানে দিনে কে খাবে? সেহেরির সময়ের পর সকাল ৬টায় কে খাবে? যদি ইফতার থেকে সেহেরি পর্যন্ত সময়টা নির্ধারণ করে ঠিক হতো। বিষয়টা সরকারের বিবেচনা করা উচিত।
তিনি বলেন, আমাদের ভাড়া উঠছে নিয়মিত, স্টাফদের সেলারি দিতে হচ্ছে- এ অবস্থায় সরকারকে বিশেষভাবে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার বিষয়ে ভাবতে হবে।
সিআরবি তাসফিয়া গার্ডেনের স্বত্ত্বাধিকারী নাজিম উদ্দিন চৌধুরী এনেল আজাদীকে বলেন, প্রতিবছর আমাদের রেস্টুরেন্টে ইফতার মাহফিল আয়োজন করতো বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। এবার আমরা রেস্টুরেন্ট খুলবো কিনা সেটা নিয়েও অনিশ্চিত। যেহেতু রেস্টুরেন্ট বসে খাওয়া নিষেধ সেক্ষেত্রে ইফতার মহফিল তো হবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাবুনগরীসহ ৪৩ জনকে অভিযুক্ত করে পিবিআইয়ের প্রতিবেদন
পরবর্তী নিবন্ধবড় ভাইকে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা