ছেলে বেলা থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রতিবাদী ও জনদরদী। বাঙালি ও বাংলার প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় প্রেম। বাঙালির স্বার্থকে তিনি সবসময় বড় করে দেখতেন। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর থেকেই তিনি প্রত্যক্ষ করলেন পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্বপাকিস্তানিদের প্রতি ক্রমাগত বিমাতাসুলভ আচরণ করতে শুরু করেছে, এমন কী মুসলমান হয়েও তারা এতদ্ঞ্চলের মুসলমানদেরও আপন করে নিতে পারেনি। বরং পূর্ব পাকিস্তানীদের আর্থ-সামাজিক ও সংস্কৃতিগতভাবে চরম শোষণে লিপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন চৌকশ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা। গোটা বাঙালি জাতিকে অশিক্ষিত ও মূর্খ করে দাবিয়ে রাখার নীলনঙা আঁচ করতে পেরে তিনি বুদ্ধিমত্তার সাথে রাজনৈতিক অঙ্গনে পদচারণা করতে লাগলেন। প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি তাদের গতিবিধির প্রতি সচেতন দৃষ্টি রাখেন। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দৃঢ় পদক্ষেপে অপরিসীম সাংগঠনিক ক্ষমতায় আওয়ামী লীগকে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড় করান এবং ১৯৬৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু এমন একজন নেতা যিনি মানুষকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনুভুতিতে জাগ্রত করে শোষনমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করতে শিখিয়েছেন। বাংলা ও বাঙালির প্রতি তাঁর ত্যাগ, ভালোবাসা আর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে তিনি ধীরে ধীরে আপামর জনসাধারণের বিশ্বাস ও নির্ভরতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। ‘বঙ্গবন্ধ’ু ও ‘বাঙালি জাতি’র মধ্যে রচিত হয়েছিল এক আস্থার সেতু বন্ধন। এ আস্থাই ছিল তাঁর শক্তির উৎস। পশ্চিমাদের শোষণ ও নির্যাতনের ষড়যন্ত্র যখন তুঙ্গে, সেই শক্তিকেই সম্বল করে বঙ্গবন্ধু গর্জে উঠলেন বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে। নানামুখী ষড়যন্ত্রের পরও সমস্ত বাঙালির এ সংগ্রামকে আটকানো যায়নি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ এ ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’ মানে ‘দৃঢ়তা’। বঙ্গবন্ধুর এ ‘দৃঢ়তা’কে জাতি লালন করে চলেছেন পরম যত্নে, অসীম সাহসিকতায়। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সেই ‘দৃঢ়তা’ কালক্রমে হয়েছে এক বিস্ময়কর বাস্তব সত্য। বাঙালিকে সত্যিই দাবায়ে রাখা যায়নি, বাঙালির স্বাধিকারের লড়াই ও মুক্তির সংগ্রামকে আটকানো যায়নি। সুদীর্ঘ নয় মাস মরণপণ লড়াইয়ের ফলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন দুনিয়ার অন্যতম পরাক্রমশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের দামাল তরুণদের কাছে হার মেনেছিল। সত্যিকার অর্থে বাঙালি ও বঙ্গবন্ধু কাউকেই দাবায়ে রাখার নয়। কারণ, বাঙালির ছিল একজন বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধুর ছিল ‘দৃঢ়তা আর তেজ’। তিনি ছিলেন হিমালয়সম বিশাল, অকুতোভয় ও অদম্য সাহসী। শত প্রতিবন্ধকতায়ও তিনি ছিলেন অন্যায়ে আপোষহীন এবং বাঙালির স্বার্থ রক্ষায় অটল ও অবিচল। মূলত ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-এর দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের কোন কিছুতেই টলাতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর অদম্য অগ্রযাত্রা, দাবায়ে রাখা যায়নি বঙ্গবন্ধুকে। কারাগারে ফাঁসির বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, কবর খোঁড়া হয়েছিল কিন্তু পাাকিস্তানিরা কোনভাবেই তাঁকে পরাস্ত করতে পারেনি, পারেনি বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে। আটকে রাখার বিপরীতে জয় হয়েছে মুক্তির, সত্য ও আত্মবিশ্বাসের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তির লড়াই পেয়েছে বিজয়ের পূর্ণতা।
বঙ্গবন্ধু মূলত বিশ্বের মানচিত্রে একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলার স্বপ্ন সাজিয়েছিলেন এবং তার জন্য আজীবন লড়ে গেছেন। সেই স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ আজ অনেকাংশে দৃশ্যমান। হাজারো বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এবং ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি, বিচক্ষণতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতালদ্ধ গতিশীল নেতৃত্বে দেশের সোনালী উন্নয়ন এখন স্বপ্নের প্রায় কাছাকাছি। অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সমৃদ্ধির স্বপ্নে পৌঁছে দেশ বিশ্বে কাঙ্খিত উচ্চ মর্যাদায় আসীন হয়েছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ ‘মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা’ এ তিনটি সূচকে ভাল অবস্থান অর্জন করে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। দেশে দারিদ্র্যের হার অনেক নীচে নেমে গেছে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির পাশাপাশি জনজীবনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নাগরিক সেবা বৃদ্ধি পেয়েছে। মোবাইল, ইন্টারনেটের ছোঁয়ায় ডিজিটালইজাশনের সুফল পাচ্ছে। ফলে গ্রামীণ জনপদসহ সর্বত্র এসেছে ব্যাপক উন্নয়ন ও পরিবর্তন। বৈদেশিক বিনিয়োগ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং প্রবৃদ্ধি সবকিছুই ইতিবাচক। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। এক সময় বৈদেশিক অনুদান ও ঋণ ছাড়া যেখানে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন ছিল শুধুই স্বপ্ন, এখন নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি হওয়া ‘পদ্মা সেতু’র মতো মেগা প্রকল্প প্রমত্ত পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সক্ষমতার জয়গান গাইছে। তাছাড়া ঢাকায় মেট্রোরেল, কঙবাজার রেললাইন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল, পায়রা বন্দর, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লা ভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্প এখন আর স্বপ্ন নয় বরং সোনালী বাস্তবতার প্রস্তুতি। জল, স্থল ও অন্তরীক্ষ সর্বত্রই এখন বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল বিচরণ। মহাকাশে দেশের বিজয় তিলক হিসেবে শোভা পাচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলইট-১’। সমুদ্রসীমায় এসেছে সমাধান। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল প্রতিবেশি দেশে। এখন বাংলাদেশ নিজেই দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর আশ্রয়, খাদ্য ও নিরাপত্তা দিচ্ছে। এদেশ বিশ্বের সামনে এখন সার্বভৌম, স্বনির্ভরতা ও সমৃদ্ধির সমুজ্জ্বল উদাহরণ। সত্তরের দশকে যে দেশকে নিয়ে ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’ মন্তব্য করা হতো, সেই দেশ আজ বিশ্বমোড়লদের চোখে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’। বিশ্বাবাসীর বিস্মিত চোখের সামনে রক্তের দামে কেনা স্বাধীনতা অর্জনেই শুধু নয়, পরবর্তী পাঁচ দশক ধরে উন্নয়ন ও নানামুখী সফলতায় বাংলাদেশ একের পর এক বিস্ময় সৃষ্টি করে চলছে। উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা মনে করিয়ে দেয়- স্বাধীনতা আমাদের স্বপ্ন ছিল নিঃসন্দেহে, একই সঙ্গে প্রত্যয় ছিল সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত অবস্থা হতে উত্তরণের এ যাত্রাপথ মোটেও সহজ ছিল না বরং ছিল বন্ধুর। অনেক বাধা-বিপত্তি আর ধ্বংসের সর্বনাশা ষড়যন্ত্রে বেষ্টিত এ পথ ছিল বড়ই দুর্গম। কিন্ত অসাধ্য ছিল না একটুও। দুর্গম পথে সফল যাত্রার মাধ্যমে জাতির পিতাই শিখিয়ে গেছেন কীভাবে ঝড়-ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ পথে মাথা উঁচু করে সামনের দিকে এগিয়ে চলতে হয়, অধিকার আদায় করে নিতে হয়, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়। জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে বাঙালি অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে জাতি হিসেবে বিশ্বে একটি মর্যাদার আসনে নিজেদের তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা- যে রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র হবে গণতন্ত্র, যে রাষ্ট্রে জাতি বর্ণ-ধর্ম-নির্বিশেষে সব মানুষ মুক্তির আস্বাদ নিয়ে বসবাস করবে। সকলের প্রত্যাশা ছিল- সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক, অসামপ্রদায়িকতার পথে সব বাধা দূর হয়ে, সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজে সামাজিক ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতা নিশ্চিতের মাধ্যমে মুক্তি ও স্বাধীনতার নতুন চেতনায় আলোকিত বাংলাদেশের বিজয় কেতন উড়বে বিশ্ব পরিমণ্ডলে। প্রকৃতপক্ষে, বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্নপূরণে চলছে পরিপূর্ণতার দুর্বার যাত্রা। আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের সরব কল্যাণকামিতায় হৃদয়ে লালিত দীর্ঘদিনের ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির টানাপোড়েনের মধ্যে অসম্ভবকে অতিক্রম করে সম্ভাবনার সোনালী দিগন্তে এগিয়ে চলেছে প্রিয় মাতৃভূমি। সত্যিই, বাংলার জনগণ ও বাংলার এগিয়ে চলাকে কখনও দাবায়ে রাখার নয়। বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ, পূর্ণতার পথে সোনালী স্বপ্ন–স্বপ্নের সোনার বাংলা।
লেখক : প্রাবন্ধিক; ডিজিএম, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড