রাহুল সাংকৃত্যায়ন ছিলেন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, সৃজনশীল পণ্ডিত ও সুলেখক। সর্বোপরী তিনি ছিলেন আধুনিক সমাজ সচেতন ও মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব। বহু ধর্ম এবং বহু ভাষায় তিনি পাঠ নিয়েছেন, ঘুরেছেন বহু দেশ। রাহুল সাংকৃত্যায়নের জন্ম ১৮৯৩ সালের ৯ এপ্রিল ভারতের উত্তর প্রদেশের আজমগড় জেলার পানহা গ্রামে। পিতা গোবর্ধন পাণ্ডে ছিলেন ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্মণ। রাহুলের আসল নাম ছিল কেদারনাথ পাণ্ডে। রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর পরিবর্তিত নাম। ১৯৩০ সালে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়ে তিনি নিজের এই নামকরণ করেন এবং এ নামেই পরবর্তীকালে বিখ্যাত হন। শৈশবে তাঁকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিন্তু প্রথাবদ্ধ জীবন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-বিমুখ কেদার বার বার ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। ১৯১০ সালে বিশ্বদর্শনে উদ্বুদ্ধ কেদার পুরোপুরি সাধুসঙ্গ গ্রহণ করেন। বিদ্বান সাধু হবার বাসনায়, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠের জন্য শেখেন সংস্কৃত ভাষা। চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, ধ্রুপদী সংস্কৃত কাব্য, ইংরেজি, অঙ্ক প্রভৃতি বিষয়ে পাঠ গ্রহণেও উদ্যোগী হন । তিনি হিন্দি, উর্দু, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, সংস্কৃত, পালি, তামিল, আবেস্তা, তাজাক, রুশ, তিব্বতি প্রভৃতি ভাষার পণ্ডিত ছিলেন। পরবর্তীকালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শেষ বয়সে সিংহলের বিদ্যালংকার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করেছেন দু বছর। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুবক রাহুল ছিলেন প্রতিবাদে সোচ্চার। এ জন্যে তাঁকে কারাবরণও করতে হয়েছে। কারাগারে তিনি কোরআন ও ইসলাম ধর্ম নিয়ে লেখাপড়া করেন। ১৯১৮ সালে রুশ বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ রাহুলের স্বপ্ন ছিল আদর্শ সাম্যবাদী সমাজ। ১৯৩৯ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত, হিন্দি ও তিব্বতি ভাষায় অধ্যাপনা করেছেন কিছুকাল। সমাজ বদলের বিপ্লবী চেতনায় বিশ্বাসী রাহুল কার্ল মার্কসের দর্শনের আলোকে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ নিয়েও লিখেছেন। ভবঘুরে মন আর বহির্বিশ্বের টানে ঘুরে বেড়িয়েছেন নানা দেশ – হয়েছেন বিশ্বপথিক। আর সেসব অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছে তাঁর রচনা। রাহুলের রচিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় দেড়শটি। এর মধ্যে মৌলিক রচনা ছাড়াও রয়েছে সম্পাদিত ও অনূদিত গ্রন্থ। এসবের মধ্যে ‘ভলগা থেকে গঙ্গা’, ‘সিংহ সেনাপতি’, ‘মানব সমাজ’, ‘নতুন মানব সমাজ’, ‘বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
পবিত্র কোরআনের হিন্দি অনুবাদ করেছিলেন রাহুল। মহামতি বুদ্ধের জীবন ও দর্শনের ওপর ‘বুদ্ধচর্যা’ নামে একখানা বৃহৎ গ্রন্থও রচনা করেছেন তিনি। তাঁর বই বাংলা সহ পৃথিবীর বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৬৩-র ১৪ই এপ্রিল রাহুল সাংকৃত্যায়ন প্রয়াত হন। কর্মকৃতীর স্বীকৃতি হিসেবে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার এবং পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন তিনি।