হেফাজত এখন জামায়াত-শিবিরের নিয়ন্ত্রণে : সাধু সাবধান
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে জাতি। একইসাথে চলছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন। ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার দশ দিনের অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে সাড়ম্বরে এই দুটো ঐতিহাসিক উৎসবকে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছে। আর, এটাও যৌক্তিক যে অনুষ্ঠানমালার শেষ দিনে সম্মানিত অতিথি হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কারণ, স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের সংগ্রামের চূড়ান্তপর্বে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান বাঙালি জাতিকে ভারতের কাছে চিরঋণী করে রেখেছে। অতএব, ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদী যতই তাঁর হিন্দুত্ববাদী ও মুসলিম-বিদ্বেষী রাজনীতির কারণে অনেকের কাছে ঘৃণিত হোন তাঁর এবারের বাংলাদেশ সফর নির্বিঘ্ন করা পুরো জাতির অবশ্য-কর্তব্য ছিল। কিন্তু, বাংলাদেশের জামায়াত-শিবির-হেফাজত-বিএনপি’র মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী মহল বাংলাদেশের ৫০তম স্বাধীনতা দিবসকেই সুপরিকল্পিতভাবে বেছে নিল ভারতে মুসলিম-নিধনকারী মোদীর সফরকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে ধ্বংসের তাণ্ডব সৃষ্টির জন্য। দেশের একাধিক স্থানে রেলস্টেশন ও রেললাইন, থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি, জেলা প্রশাসক অফিস, সরকারি ভূমি অফিস, প্রেস ক্লাব, আলাউদ্দিন সংগীত একাডেমি, আওয়ামী লীগ অফিস, সড়ক-মহাসড়কের যানবাহন ও দোকানপাট ভাঙচুরে বিধ্বস্ত হলো কিংবা অগ্নিসন্ত্রাসে ভস্মীভূত হলো হেফাজত-লেবাসধারী জামায়াত-শিবির-বিএনপি ক্যাডারদের ২৬ ও ২৭ মার্চের পরিকল্পিত তান্ডবের শিকার হয়ে। দুঃখজনকভাবে পুলিশও তাদের উসকানির ফাঁদে ধরা দিল গুলিবর্ষণে লাশ ফেলার অত্যুৎসাহী তৎপরতার মাধ্যমে, ফলে ঝরে গেল ১৭টি তাজা প্রাণ।
এহেন তাণ্ডব যে ঘটতে পারে তার সুস্পষ্ট আলামত কয়েকদিন আগেই পাওয়া গিয়েছিল জনৈক হিন্দু যুবক কর্তৃক হেফাজত নেতা মামুনুল হককে সোশ্যাল মিডিয়ায় অপমান করার অভিযোগ তুলে সুনামগঞ্জের হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রামে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায়, কিন্তু পুলিশকে হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যথেষ্ট শক্তিশালী ও সংগঠিত অবস্থানে দেখা যায়নি হেফাজত-ক্যাডারদের ২৬ ও ২৭ মার্চের সন্ত্রাসী তাণ্ডবের মোকাবেলায়।(এমনকি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত পশ্চাদ্পসরণের অভিযোগও উঠছে)। গত বছর হেফাজতে ইসলামের প্রয়াত নেতা আল্লামা আহমদ শফীকে তাঁর মৃত্যুর আগের দিন মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে অপমানজনকভাবে পদত্যাগে বাধ্য করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার ন্যক্কারজনক ঘটনার মাধ্যমে জামায়াত-শিবির যে হাটহাজারী মাদ্রাসা সহ সারা দেশের অধিকাংশ কওমী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছে ঐ ব্যাপারটিকে যথাযথ আমলে নিলে সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লামা শফীর জানাজায় তাঁর পুত্র আনাস মাদানীকে কোন বক্তব্যই রাখতে দেয়নি জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা, এমনকি মুদ্দারের খাটিয়া-বহন কিংবা লাশ-দাফনেও জামায়াত-শিবিরের একচেটিয়া দাপটই দেখা গেছে টেলিভিশনের ক্যামেরায়! এরপর মওলানা জুনাঈদ বাবুনগরীর নেতৃত্বে হেফাজতের যে মজলিশে-শুরা গঠিত হয়েছে সেখানে জামায়াতপন্থীরাই আধিপত্য কায়েম করেছে। বোঝা যাচ্ছে, আনাস মাদানী এবং আল্লামা শফীর অনুসারীরা এখন হেফাজতে ইসলামে অপাঙক্তেয় হয়ে পড়েছেন। এর মানে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আল্লামা শফীর সমঝোতা ও সখ্যতার মাধ্যমে ২০১৩ সাল থেকে সাত বছর ধরে কওমী মাদ্রাসাগুলো সরকার থেকে একের পর এক অভূতপূর্ব সুবিধা আদায়ে সফল হলেও ঐ সমঝোতা হেফাজতে ইসলামের অধিকাংশ নেতা-কর্মীর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। ঐ সাত বছর হেফাজতের পক্ষ থেকে আল্লামা শফী যে বড় ধরনের কোন সরকার-বিরোধী কর্মসূচি দেননি সেটাও ঐ মহলের কাছে অসহনীয় ছিল, কিন্তু ‘বড় হুজুরের’ বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অবস্থানে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি সঞ্চয় করতে তাদের ২০২০ সাল পর্যন্ত লেগে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আল্লামা শফী কর্তৃক মওলানা জুনাঈদ বাবুনগরীকে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কারকে সেন্টিমেন্টাল ইস্যু বানিয়ে আল্লামা শফীর মৃত্যুর আগের দিন হামলা-ভাঙচুরের মাধ্যমে হাটহাজারী মাদ্রাসা জামায়াতপন্থী-হেফাজতিদের দখলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, এ-দখল গত কয়েক মাসে আরো মজবুত হয়েছে। অতএব, হেফাজতে ইসলাম আবার ২০১৩ সালের মত সরকার-বিরোধী জঙ্গি কার্যক্রমে ফিরে যাচ্ছে! বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে মামুনুল হকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা প্রোপাগান্ডা ও আন্দোলনের তোড় থেকে ক্ষমতাসীন মহল হেফাজতের রাজনীতির এই মোড়-পরিবর্তনের কিঞ্চিৎ আভাস পেলেও হঠাৎ করে ঐ আন্দোলনে ভাটা পড়ার ব্যাপারটি কোন গোপন লেনদেনের ফসল কি না তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সন্দেহ রয়েছে! ঘটনাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব এখনো হেফাজতের নেতাদের সাথে গোপন সমঝোতা স্থাপনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন! হামলার মামলাগুলোতে উচ্চ-পর্যায়ের কোন হেফাজত-নেতাকে আসামী না করার ব্যাপারটি এই দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ হয়তোবা! কিন্তু গোপন সমঝোতার মাধ্যমে যে জামায়াতপন্থী-হেফাজতিদেরকে ম্যানেজ করা যাবে না, এবং তারা যে এহেন সমঝোতার প্রয়াসকে ভন্ডুল করতে বদ্ধপরিকর তারই অকাট্য প্রমাণ ২৬ ও ২৭ মার্চের তান্ডবলীলা। অদূর ভবিষ্যতে হেফাজতের কাঁধ থেকে সিন্দবাদের এই ভূতকে সহজে নামানো যাবে না।
অতএব, এই সমঝোতার খেলা পরিত্যাগ করে কঠোর প্রতিরোধের পথে জামায়াত-শিবির-হেফাজত-বিএনপি’র ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবেলায় সত্যিকারভাবে মনোনিবেশ করা ছাড়া ক্ষমতাসীন মহলের কোন গত্যন্তর নেই বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। মনে রাখতে হবে, জামায়াত-শিবির-হেফাজত-বিএনপি’র এখনকার ‘কমন এজেন্ডা’ হলো বাংলাদেশের চমৎকার অর্থনৈতিক গতিশীলতাকে থামিয়ে দেওয়া এবং সম্ভব হলে সরকার উৎখাত করা। কারণ, অর্থনৈতিক সাফল্য অব্যাহত থাকলে তাদের পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি ক্রমশ জনগণের কাছে অপাঙক্তেয় হয়ে যাবে। সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের বিরাট বিস্ময়। ১৯৭১ সালের জন্মলগ্নে যে দেশটি বিশ্বের জনগণের দান-খয়রাত ছাড়া টিকে থাকতে পারবে না বলা হচ্ছিল সে দেশটি এই পঞ্চাশ বছরে উন্নয়নের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা ভাইরাস মহামারি আঘাত হানার আগে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে ৮.২ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। মহামারির মরণ-ছোবল সত্ত্বেও বিশ্বের যে কয়েকটি দেশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ধনাত্মক রাখতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ তার অন্যতম, ২০১৯-২০ অর্থ-বছরেও আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫.২৪ শতাংশ। আরো বিস্ময়কর হলো, মহামারি সত্ত্বেও ২০২০ সালে বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী-রেমিট্যান্স ২৩ শতাংশ বেড়ে ২১.৭৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। ফলে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের মার্চে ৪৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যা দক্ষিন এশিয়ায় ভারতের পর দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ। ২০১৯-২০ অর্থ-বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমে ৫.২৪ শতাংশে দাঁড়ালেও তা বিশ্বের উন্নয়ন-চিন্তাবিদদের দৃষ্টিতে অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কারণ, ২০২০ সালে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে গেছে মহামারির মরণ-ছোবলে। ২০১৮ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার শর্ত পূরণকারী বাংলাদেশ ২০২১ সালে ঐ উত্তরণ নিশ্চিত করেছে। ১৯৮১-৮২ অর্থ-বছরে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান এদেশের জিডিপি’র ১৩.৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল, তা ক্রমশ কমে এখন জিডিপি’র দুই শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পাকিস্তানকে উন্নয়নের প্রায় সকল সূচকে পেছনে ফেলে এসেছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের বাংলাদেশকে দক্ষিন এশিয়ার ‘ইমার্জিং টাইগার’ অভিহিত করা হচ্ছে। ২০২০ সালে মাথাপিছু জিডিপি’র বিচারে বাংলাদেশ ভারতকেও টপকে যাবে বলে পূর্বাভাস দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে আইএমএফ।
বাংলাদেশের উন্নয়নের যেসব ডাইমেনশান বিশ্বের কাছে চমকপ্রদ বিবেচিত হচ্ছে সেগুলো হলো: ১) ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থান করছিল, যেখান থেকে ২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাস মহামারির তান্ডব শুরু হওয়ার পর্যায়ে দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ২০.৫ শতাংশে নেমে গেছে। (গত এক বছরে মহামারির কারণে দারিদ্র্য ৫ শতাংশ বেড়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে)।
২) ১৯৭৬-৭৭ অর্থ-বছর থেকে ১৯৮১-৮২ অর্থ-বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি’র অনুপাত হিসেবে বৈদেশিক ঋণ-অনুদান ১০ শতাংশের বেশি ছিল, ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে জিডিপি’র দুই শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশ এখন আর খয়রাত-নির্ভর দেশ নয়, একটি বাণিজ্য-নির্ভর দেশ।
৩) এক দশক ধরে প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশ তার লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত অর্জন করে চলেছে। এর মানে, বাণিজ্য ভারসাম্যের ঘাটতি এখন আর সংকটজনক নয়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের বৈধ পথে প্রেরিত রেমিট্যান্সের চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধির হার এবং বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রশংসনীয় প্রবৃদ্ধি দেশের লেনদেন ভারসাম্যের এই স্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
৪) জনসংখ্যার অত্যধিক ঘনত্ব, জমি-জন অনুপাতের অত্যল্পতা এবং চাষযোগ্য জমির ক্রম-সংকোচন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে এখন ধান-উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ছিল মাত্র এক কোটি দশ লাখ টন, ২০১৯ সালে তা সোয়া তিন গুণেরও বেশি বেড়ে তিন কোটি বাষট্টি লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। ধান, গম ও ভুট্টা মিলে ২০১৯ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল চার কোটি তিপ্পান্ন লাখ টন। সত্তর লাখ টন আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে এক কোটি দুই লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। (এখনো আমরা অবশ্য প্রায় ৫০/৫৫ লাখ টন গম আমদানি করি)। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। তরিতরকারী উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। বলতে গেলে বাংলাদেশে একটি কৃষি বিপ্লব চলমান।
৫) করোনা মহামারির আগে ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হয়েছে ৮.২ শতাংশ। মহামারি সত্ত্বেও ২০১৯-২০ অর্থ-বছরে মাথাপিছু জিএনআই প্রাক্কলিত হয়েছে ২০৬৪ ডলার, যা ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে ছিল ১৯০৯ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে শিল্পখাতের অবদান জিডিপি’র ৩৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে, বিনিয়োগ-জিডিপি’র অনুপাত ৩১.৫৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
৬) ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল ৪২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি, অথচ ১৯৮১-৮২ অর্থ-বছরে রফতানি আয় ছিল মাত্র ৭৫২ মিলিয়ন ডলার। (করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে ২০১৯-২০ অর্থ-বছরে রফতানি আয় ৩৩.৬৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে)। রফতানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশই আসছে বুনন ও বয়নকৃত তৈরি পোশাক খাত থেকে। চীনের পর বাংলাদেশ পোশাক রফতানিতে বিশ্বের দ্বিতীয়-বৃহত্তম রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে আবারো সঞ্জীবিত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, সিরামিক পণ্য, জাহাজ নির্মাণ ও কৃষি-ভিত্তিক খাদ্যপণ্য রফতানি বাজারে ভালই সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
৭) বাংলাদেশের এক কোটি কুড়ি লাখেরও বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন ও বসবাস করছেন। ২০২০ সালে প্রাতিষ্ঠানিক পথে (ভড়ৎসধষ পযধহহবষং) রেমিট্যান্স প্রবাহ ২১.৭৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে।
৮) ক্ষুদ্র ঋণ আন্দোলনের সাফল্য গ্রামের ভূমিহীন নারীদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার একটা অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এক চতুর্থাংশের বেশি ঋণগ্রহীতা তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সাফল্য অর্জন করেছেন। অবশ্য, ক্ষুদ্রতর অনুপাতের ঋণগ্রহীতা সাফল্যের সাথে দারিদ্র্য থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পেরেছেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শুধু ক্ষুদ্র ঋণকে এদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিস্টেম কর্তৃক লালিত দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টির প্রক্রিয়াগুলোকে কার্যকরভাবে মোকাবেলার যথার্থ প্রতিষেধক বিবেচনা করা সমীচীন নয়। কিন্তু, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার এই সফল উদ্ভাবনটিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক দিক উন্মোচনের কৃতিত্ব দিতেই হবে।
৯) বাংলাদেশের নারীদের প্রায় ৩৮ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল। দেশের দ্রুত বিকাশমান পোশাক শিল্পে ৩৩ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, আর এই শ্রমিকদের ৬০ শতাংশেরও বেশি নারী। সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক অবস্থানের এসব নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পখাতে কাজের ব্যবস্থা করাটা তাঁদের বঞ্চনা ও চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে একটি তাৎপর্যপূর্ণ নিরোধক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। ক্ষুদ্রঋণের সহায়তায় নারীর স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও বাংলাদেশ বিশ্বে সফল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে।
১০) বাংলাদেশে এখন ষোল কোটি মোবাইল টেলিফোন রয়েছে, এগার কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রশংসনীয়ভাবে গতিশীল করার প্রধান কৃতিত্ব শেখ হাসিনাকে দিতেই হবে। এখন তাঁর অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি’ কৌশল অবলম্বন করে একটি সমতাকামী সমাজ প্রতিষ্ঠা। কৃষিতে গণমুখী নীতি প্রণয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য হ্রাস, দরিদ্র জনগণকে সুলভে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, সুলভে উৎপাদনশীল জনগণের কাছে ব্যাংক ঋণ পৌঁছানো, অগ্রাধিকার সহকারে প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, কঠোরভাবে দুর্নীতি দমন এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করা এই কৌশলের মূল স্তম্ভ। সর্বোপরি, আয়বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে আয় পুনর্বন্টনকে রাষ্ট্রের মূল মিশন হিসেবে গ্রহণ করতেই হবে। এই সুকঠিন যাত্রাপথকে আরো কন্টকাকীর্ণ করার জন্য এবং পারলে অর্থনীতিকে অচল করার জন্য জামায়াত-শিবির-হেফাজত-বিএনপি’র ‘ইউনাইটেড ফ্রন্ট’ তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করবেই। সাধু সাবধান!
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়