উপমহাদেশের খ্যাতিমান সুরসম্রাট এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অকৃত্রিম বন্ধু পণ্ডিত রবি শঙ্কর। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে বহির্বিশ্বে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে এই সুরস্রষ্টার অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। রবি শঙ্করের জন্ম ১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল ভারতের বারানসিতে। তাঁর আদি পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের নড়াইলের কালিয়ায়। শৈশবে নাচ শিখেছেন বড় ভাই নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের কাছে। নাচের দলের সদস্য হয়ে ভাইয়ের সাথে সেই ছেলেবেলাতেই ভারত এবং ইউরোপ ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। পরবর্তী সময়ে নাচ ছেড়ে সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সেতার শিখতে শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে সেতারে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া সমাপ্তির পর রচয়িতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে রবি শঙ্করের। সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু’ ত্রয়ী এবং রিচার্ড অ্যাটেনবোরাফের ‘গান্ধী’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। পাশ্চাত্যেও রবি ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয়। বিশ শতকের মধ্যভাগে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশ সফরের মাধ্যমে ভারতীয় সংগীতকে বিশ্বে উপস্থাপন করেন রবি। সেতার ও অর্কেস্ট্রার সমন্বয়ে পাশ্চাত্য সংগীতে এক বিশেষ ধারার সূচনা হয় তাঁর হাতে। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন বিশ্বখ্যাত বেহালাবাদক জুরি মেনুহিন এবং বিটল্স-এর শিল্পী জর্জ হ্যারিসনের সাথে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর মাঝামাঝি সময়ে রবি শঙ্কর বন্ধু জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে নিউ ইয়র্কের ‘ম্যাডিসন স্কয়ারে’ একটি কনসার্টের আয়োজন করেন। বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনির বর্বরতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা ও শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য এই কনসার্টের আয়োজন করা হয়। বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে এটি ছিল সে সময় এক দুঃসাহসিক ভূমিকা। সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ‘ভারতরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত হন। গ্রামি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি। প্রায় সাত বছর ভারতের পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রয়াত হন বাংলাদেশের এই ভিনদেশী সহযোদ্ধা, সেতারের জাদুকর পণ্ডিত রবি শঙ্কর।