পবিত্র কুরআনের আলোকে ইমামের আনুগত্য:
আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “যে দিন আমি প্রত্যেক দলকে তাদের ইমাম সহকারে আহবান করবো। (সূরা: বনী ইসরাইল, পারা: ১৫, আয়াত: ৭১), আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী (র.) বলেন, পৃথিবীতে যারা যে মতাদর্শে বিশ্বাসী ও অনুসারী প্রত্যেক কে তাদের মাযহাব অনুসারে ডাকা হবে। যেমন বলা হবে হে হানাফী, হে শাফেয়ী, পথভ্রষ্টদের ডাকা হবে হে মুতাযিলী, হে কদরীয়া (তাকদীর অবিশ্বাসী সম্প্রদায়)। ইমাম কুরতুবী তাফসীরে আহকামুল কোরআন, খন্ড: ১০, পৃ: ২৯৭)
ইমাম আযম (র.)’র পরিচিতি: জন্ম ৮০ হিজরি কুফা নগরীতে, নাম: নুমান, কুনিয়াত বা উপনাম আবু হানিফা, উপাধি: ইমাম আযম। পিতার নাম: সাবিত, দাদার নাম: যুতী। তিনি ছিলেন পারস্যের অধিবাসী, দাদা অগ্নি উপাসক ছিলেন। ৩৬ হিজরিতে ইসলামে দীক্ষিত হন। দাদা যুতী সস্ত্রীক মক্কায় রওয়ানা হন সেখানে থেকে কুফায় পৌছে হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর সান্নিধ্য অর্জন করেন।
ইমাম আযম ছিলেন একজন তাবিঈ: হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমাদের থেকে উত্তম যুগ হল আমার যুগ অত:পর তাদের পরবর্তীদের (তাবেঈদের) অত:পর তাদের পরবতী তবে তাবেঈদের। (বুখারী, হাদীস নং: ২৫০৮)
ঈমান ইসলাম সহকারে যারা কোন সাহাবী ও তাবেঈদের সাক্ষাৎ করেছে জাহান্নামের আগুন তাদের স্পর্শ করবেনা, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, ঐ মুসলমানকে (জাহান্নামের) আগুন স্পর্শ করবেনা যে আমাকে দেখেছে (সাহাবী) বা যে আমাকে দেখেছে তাকে দেখেছে (তাবেঈ)। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং: ৩৮৫৮)
বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (৮৫২হি) সাহাবীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, সাহাবী হলেন যিনি মুমীন অবস্থায় নবীজির সাক্ষাৎ করেছেন এবং ইসলামের উপর যিনি ইন্তেকাল করেছেন। অনুরূপভাবে তাবেঈ’র সংজ্ঞায় তিনি বর্ণনা করেন, মুমিন অবস্থায় যিনি সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং ইসলামের উপর ইন্তেকাল করেছেন তিনি হলেন তাবেঈ। (নুযহাতুন নযর শিরহি নুখবাতিল ফিকর, পৃ: ৬৪,৬৭)
ইমাম আযম আবু হানিফা (র.) তাবেঈ হওয়ার ব্যাপারে ২১জন ইমামের ২৮টি বর্ণনা পরিলক্ষিত হয়। ইমাম আযম (র.)’র যুগে ২২ জন বা ২৬ জন সাহাবা জীবিত ছিলেন। তবে তিনি কয়জন সাহাবীর সাক্ষাৎ লাভ করেন এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। আল্লামা ইবনে হাজর মক্কী (র.)’র রচনা মতে ৮ জন সাহাবায়ে কেরামের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ প্রমাণিত। বিশেষত হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) এ সময় বসরায় ছিলেন ৯৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম আযম বর্ণনা করেন, আমি হযরত আনাস ইবনে মালিককে নামায পড়তে দন্ডায়মান অবস্থায় দেখেছি। (আবু নাঈম আসবাহানী, মুসনাদুল ইমাম আবী হানিফা, পৃ: ১৭৬)
তিনি ছাড়াও অন্যান্য শহরে অপরাপর সাহাবায়ে কেরাম বিদ্যমান ছিলেন। হযরত ওয়াসেলা ইবনে আসকা, শাম ৮৫ হি., হযরত সাহল বিন সাদ (মদীনা মুনাওয়ারা) (৮৮হি:), ইবনে আবী আওফা আবদুল্লাহ যিনি সাহাবীর পুত্র সাহাবী, ইমাম আযম সাত বছর বয়সে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করেন তিনি ৮৭ হিজরিতে কুফাতে ওফাতবরণকারী সর্বশেষ সাহাবী। (ইরশাদুস সারী শরহে বোখারী), হযরত আবু তুফাইল আমের ইবনে ওয়াসেলা (মক্কা) (১১০হি.) ইমাম আযম ১৩ বছর বয়সে হজ্জে বায়তুল্লাহ আদায় কালে ৯৩ হিজরিতে সাহাবী আবু তুফাইল আমের ইবনে ওয়াসেলাকে দেখেছেন।
(আল্লামা হানিফ খান রিজভি, হালাতে ফুকাহা ওয়া মুহাদ্দিসীন, পৃ: ১৩)
ইমাম আযম সম্পর্কে নবীজির ভবিষ্যৎ বাণী: ইমাম আযম (র.) সম্পর্কে আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুসংবাদ রয়েছে। বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, ঈমান যদি সুরাইয়া নক্ষত্রে চলে গেলেও কিছু লোক বা এক ব্যক্তি তা অর্জন করে নেবে। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং: ৪৬১৫)
বর্ণিত হাদীসটি ইমাম আযমের সত্তর বছর বয়সের অনুপাতে এ হাদীসের সত্তরটি সনদ চল্লিশ জন বিখ্যাত মুহাদ্দিসের বরাতে বর্ণিত হয়েছে। এ হাদীস সম্পর্কে ইমাম ইবনে হাজর মক্কী (র.) মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, এ হাদীস দ্বারা যে ইমাম আবু হানিফা উদ্দেশ্য তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট, এতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।
ইমাম আযমের ইবাদত ও সাধনা: হযরত আবু বকর খতীবে বাগদাদী, হযরত ইবনে কাসীর, কুতবুল আকতাব ইমাম শা’রানী বর্ণনা করেন ইমাম আযম চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত এশার অজু দিয়ে ফজর নামায আদায় করেছেন। তিনি পুরো জীবনে সাত হাজার বার কুরআন খতম করেছেন। (তারিখে বাগদাদ, খন্ড ১৩, পৃ: ৩৫৪, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড: ১০, পৃ: ১০৭, তাবকাতে কুবরা,পৃ: ৪৬)
ইমাম আজম প্রতি রমজানে দিনে ৩০ রাতে ৩০ তারাবীতে ১ খতম মোট ৬১ বার কুরআন মাজীদ খতম দিতেন। ৫৫ বার হজ্বে বায়তুল্লাহ আদায় করেছেন। এক রমজানেই ১২০ বার ওমরা আদায় করেছেন। হযরত আবু মুতঈ (র.) বর্ণনা করেন, ছয় বৎসর হেরমে কা’বা তে ছিলাম, যখনই আমি হেরম শরীফে যেতাম ইমাম আযম (র.) কে খানায়ে কা’বায় তাওয়াফরত অবস্থায় পেতাম। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড ২, পৃ: ৪৬৩)
হানফী মাযহাবের প্রবর্তক: ইমাম আযমের ওস্তাদ হুম্মাদের ইন্তেকালের পর ইমাম আযম ফিকহ শাস্ত্র প্রণয়নের কাজ শুরু করেন। হযরত মোল্লা আলী ক্বারী (র.)’র বর্ণনা মতে ৩৮ হাজার ইবাদত সম্পর্কিত ও ৪৫ হাজার মানবজীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ৮৩ হাজার মৌলিক মাযআলার সমাধান দিয়েছেন। তাঁর প্রণীতি মূলনীতির আলোকে প্রাচীন ও আধুনিক বিষয়ে লক্ষ লক্ষ মাসআলার পর্যালোচনা, গবেষণা, মানব জাতির যুগ জিজ্ঞাসার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গ আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতী (র.) বর্ণনা করেন, নিশ্চয় ইমাম আবু হানিফা (র.) সর্বপ্রথম শরীয়তের বিভিন্ন বিধানাবলী আহকামে শরীয়ত মাসআলা মাসায়েল সংকলন করেন। বিভিন্ন অধ্যায় ভিত্তিক বিন্যাস করেন। অত:পর ইমাম মালিক (রা.) মুয়াত্তার বিন্যাসে ইমাম আযমের অনুসরণ করেন। ইমাম আবু হানিফার পূর্বে কেউ এ কাজে অগ্রসর হয়নি। (তাবয়ীদুস সহীফা, পৃ: ১১৯)
বিশ্বের অসংখ্য মুসলিম রাষ্ট্রে হানাফী মাযহাব রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। ইসলামে প্রচলিত চারটি মাযহাবের মধ্যে হানফী মাযহাব সর্বশ্রেষ্ঠ। পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমানদের কাছে হানাফী মাযহাবই ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বিগত তেরশত বৎসর ধরে এ মাযহাবের উপর বিশ্বব্যাপী আরবি, উর্দু, ফার্সী, হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় রচিত হয়েছে হাজার হাজার ফিকহ তথা ইসলামী আইন শাস্ত্রের গ্রন্থাবলী। হানাফী শাফেয়ী মালেকী হাম্বলী মাযহাবের ইমাম চতুষ্টয় আক্বিদার ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী। ইমাম তাহাবী (র.) বর্ণনা করেন, চার মাযহাব আক্বিদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন। (আল আক্বিদাতুত তাহাবীয়া)
যে কোন মুসলমানের জন্য চার মাযহাবের যে কোন একটি মাযহাব অনুসরণ করা ফরজ। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, জ্ঞানবানদের কে জিজ্ঞাসা করো যদি তোমাদের জ্ঞান না থাকে। (আয়াত: সূরা: আম্বিয়া, আয়াত: ৭) এ আয়াত দ্বারা মাযহাবের ইমামের অনুসরণ ওয়াজিব করা হয়েছে। মাযহাব অস্বীকার ও বিরোধীতা করা হলে পথভ্রষ্ট ও গোমরাহ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
ইন্তেকাল: প্রসিদ্ধ বর্ণনামতে ইমাম আযম ৭০ বছর বয়সে ২ শাবান ১৫০ হিজরিতে বাগদাদে ইন্তেকাল করেন। বাগদাদের বিচারপতি হাসান ইবনে ওমারা কুফী ইমাম আযমকে গোসল দিয়েছেন। তাঁর প্রথম জানাযায় পঞ্চাশ হাজার লোকের সমাগম হয়। তখনকার সময়ে অস্বাভাবিক উপস্থিতির কারণে জানাযার ছয়টি জামাত হয়েছিল। বাগদাদের খেযরান নামক কবরস্থানের পূর্ব পার্শ্বে মসজিদ সংলগ্ন স্থানে তিনি শায়িত আছেন। হে আল্লাহ আমাদেরকে এই মহান ইমামের প্রবর্তিত মাযহাব অনুসরণ করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
[ইসলাম সম্পর্কিত পাঠকের প্রশ্নাবলি ও নানা জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি। আগ্রহীদের বিভাগের নাম উল্লেখ করে নিচের ইমেলে প্রশ্ন পাঠাতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
ঊসধরষ : ধুধফরবফরঃড়ৎরধষ@মসধরষ.পড়স]