করোনাকালে অটিজম শিশুর স্বাস্থ্য সেবা

প্রফেসর (ডা:) মাহমুদ এ চৌধুরী আরজু | বৃহস্পতিবার , ১ এপ্রিল, ২০২১ at ৪:৪২ পূর্বাহ্ণ

আগামীকাল ২রা এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। করোনাকালীন এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- ঈযধষষবহমবং ধহফ ঙঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃরবং রহ ধ চড়ংঃ চধহফবসরপ ডড়ৎষফ অর্থাৎ করোনাউত্তর অটিজম শিশুদের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি। অটিজম বা অঝউ কোন রোগ নয়। এটি মস্তিষ্কের বিকাশ জনিত সমস্যা মাত্র। ফলে শিশুর মানসিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতা থাকে। স্বাভাবিক শিশুর মত ঐ শিশু পরিবারের, সমাজের কিংবা বন্ধুবান্ধবের মাঝে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। দেখতে শুনতে স্বাভাবিক ও উজ্জ্বল বর্ণের হলেও এরা নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা থাকতে পছন্দ করে। যেটার লক্ষণ কারো ক্ষেত্রে চোখে বুঝা নাও যেতে পারে। কারো বা কমবেশি ঈড়-সড়ৎনরফরঃু থাকে। এই ধরনের শিশু অনেক অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন- বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি, উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করা, চেঁচামেচি করা, সবকিছু ভেঙ্গে ফেলা, মা বাবা বা আত্মীয় স্বজনকে মারধর করা বা কোন কিছু ছুড়ে মারা, ঠিক মত টয়লেট ট্রেনিং না করা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে খিচুনী বা মানসিক পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। এরা অনেক সময় প্রকৃতি ভালোবাসে, বাহিরের জগতের নীল আকাশ, কালো মেঘ বা বৃষ্টি হলে খুবই উৎফুল্ল হয়ে যায়। আবেগ প্রবণ হয়, অনেক সময় বাহিরে বের হয়ে রাস্তায় বা পার্কে খুব আনন্দের সাথে দৌড়াদৌড়ি করে, গুনগুন গান করে, ফুলকে ভালোবাসে, প্রজাপতির সাথে খেলা করে, মনে মনে অনেক কবিতা আবৃত্তি করে। বেশীরভাগ অটিজম শিশুর সমস্যা তত গুরুত্ব হয় না। মারাত্মক হলে ভিন্ন কথা।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিতে বেশিরভাগ অটিজম শিশু ঘরেতেই আছে, স্কুল বা বাহিরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমাদের দেশের বাস্তবতায় আমাদের বাসস্থান অটিজম শিশুর জন্য মানান সই নয়। তাই এই পরিস্থিতিতে অটিজম আক্রান্ত শিশুর মা বাবারা স্বস্তিকর অবস্থায় নেই বলে আমার মনে হয়। এক্ষেত্রে কিছু উপদেশ বা পরামর্শ আমি লিখছি যা পরিবারের কাজে আসতে পারে। আগেই বলেছি বেশিরভাগ অটিজম শিশুরা প্রকৃতি ভালোবাসে। তাই ঘরের ভিতরে প্রাকৃতিক পরিবেশ আনুন। ঘরের ১টি রুমকে ফার্নিচার সরিয়ে রুমটাকে খোলামেলা রাখুন। প্রয়োজনে ঘরটিকে কৃত্রিম গাছপালা, ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখুন। রং তুলি দিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত ছবি দেয়ালে লাগান। তাদের সাথে এমনভাব করুন বা আচরণ ভঙ্গি করুন যেন এটি একটি বাহিরের পরিবেশ, কিছু কাগজের ফুলও তৈরি করে রাখতে পারেন। যেহেতু অটিজম শিশুরা বহুদিন যাবৎ ঘরে আটকে আছে সেহেতু তাকে সপ্তাহে ৭ দিনের জন্য ১টি রুটিন করে দিন। সকালে ঘুম থেকে রাত্রে বিছানায় যাওয়া পর্যন্ত রুটিন করে ফেলুন। একেক দিন একেক রকম বৈচিত্র নিয়ে রুটিন করবেন। দেওয়ালে বড় বড় করে লিখে রাখুন। কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত তার কি কাজ এটা অনেকটা ক্যাডেট কলেজের ছাত্রদের রেজিমেন্টেড রুটিন এর মত। তবে সে ঐ রুটিনে অনিহা প্রকাশ করলে রুটিনে কিছু পরিবর্তন আনুন। শিশুর কাপড় চোপড় সব সময় ঢিলেঢালা ও কালারফুল হতে হবে। মাঝে মাঝে শিশুকে গরম পানিতে গোসল করাবেন। তখন সমস্ত শরীরে চেপে চেপে গা হাত পরিষ্কার করাবেন এ ধরনের চাপ/প্রেসার অনেকটা থেরাপির কাজ করবে। ঘরের মাঝখানে একটি দোলনা লাগাবেন। সম্ভব হলে ছাদে নিয়ে একটু হাটাহাটি করবেন। অথবা খুব ভোরে সামনের রাস্তায় কিছুক্ষণ হাটা হাটি বা দৌড়াদৌড়ি করবেন। আপনার শিশু যদি তার সমস্যার কারণে কোন ঔষধ খেয়ে থাকে তা অবশ্যই নিয়মমত খাওয়াতে হবে। অটিজম আক্রান্ত শিশু প্রায় কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগে। প্রয়োজনে রাত্রে ১ চামচ ইছুবগুলের ভূসি ১ গ্লাস পানিতে গুলিয়ে ঘুমানোর আগে খাইয়ে দিবেন। প্রয়োজনে কোষ্ঠ কাঠিন্যের ঔষধ ব্যবহার করবেন। খিুচনী থাকলে খিচুনীর ঔষধ সঠিকভাবে খাওয়াতে হবে। আর মানসিক অস্থিরতা থাকলে অহঃর- চংুপযড়ঃরপ ড্রাগ যেমন- জবংঢ়বৎফড়ষ স্বল্প ডোজে দিনে ও রাত্রে খাওয়ানো যেতে পারে। তবে পরামর্শ থাকবে ঔষধ খাওয়ানোর আগে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে দিলে ভালো। চর্বিযুক্ত খাবার খাবে না, আঁশযুক্ত খাবার, সবজি খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন, টিভি বা ট্যাব দেখা একদম বন্ধ করে দেবেন না। তবে কার্টুন নয় গবধহরহমভঁষ কোন প্রোগ্রাম হলে ভাল। শিশুরা প্রত্যেক কথা বা কাজকে বিশ্লেষণ করবেন। বিরক্ত হলে অন্য ঞড়ঢ়রপ এ যাবেন। সব সময় তার ন্যূনতম কাজকে প্রশংসা করবেন। কিছুতেই তিরস্কার করবেন না। বস্তুত এ সময়ে মা বাবাকে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নিতে হবে। প্রয়োজনে স্কুল শিক্ষক বা গুগল থেকে পরামর্শ নিবেন।
করোনা এই মহামারিতে অটিজম শিশুদের নিয়ে মা বাবারা উদবিঘ্ন্ন থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে দেশে করোনার প্রভাব আবারও বেড়েছে। এতে অটিজম শিশুদের সমস্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। তারা ঝুঁকিতে থাকবে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র এই পরিস্থিতিতেও সেবা কার্যক্রম চালু রেখেছে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত এই সেবা কার্যক্রম চালু আছে। চিকিৎসাসহ সব ধরনের থেরাপি যেমন- লো-ভিশন, ডেভেলপমেন্টাল থেরাপি, সাইকোলজি, আর.এন.ডি.এ, স্পীচ থেরাপী, নিউট্রিশান, অকুপেশনাল থেরাপী, ইইজি, হেয়ারিং ইত্যাদি। প্রয়োজনে আসার পূর্বে যোগাযোগ করে আসবেন। মোবাইল- ০১৮৪২৪৫৭৪৪৭, ফোন- ০৩১-৭১১২৩৬, ২৫২০০৬৩ (এক্স-১২২)।
পরিশেষে বলতে চাই বিগত ২০ বৎসরের অধিক সময় ধরে এই নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডারস শিশুদের নিয়ে কাজ করছি। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে হয়তো বা তারা ভালো নেই। কেউবা ঔষধ পাচ্ছে না, কেউবা থেরাপীর জন্য সেন্টারে আসতে পারছেনা, কেউবা এই মহামারিতে অর্থের অভাবে দিশেহারা হয়ে উঠেছেন। এসব কথা মনে হলে মন খুব ব্যথিত ও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। মহান আল্লাহ তায়ালা তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও। এ অসহায় শিশুদের জন্য হলেও তুমি এই করোনা মহামারি থেকে আমাদের রক্ষা কর। কারণ তুমি মহান! তুমি মহান! তুমি মহান।
লেখক : পরিচালক, অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র,
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনা কি পরিশুদ্ধ করতে পারেনি এখনো
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল