প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৩১ মার্চ, ২০২১ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

চট্টলার কৃতী পুরুষ এ কে খান

শিল্পে, রাজনীতিতে, মানবকল্যাণে নিবেদিত প্রাণ চট্টগ্রাম অঞ্চলের কয়েকজন কৃতী পুরুষের মধ্যে এ, কে, খান (আবুল কাশেম খান) কে অন্যতম একজন হিসেবে গণ্য করা যাবে।
শিল্পজগতের পথিকৃৎ, প্রাথমিক জীবনে বিচারক, রাজনীতিবিদ মেধা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব এ কে খানের ৩১ মার্চ ৩০ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ৫ এপ্রিল ১৯০৫ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীর বর্তমান চান্দগাঁও থানার মোহরা গ্রামে তার জন্ম। তাঁর পিতা আলহাজ্ব আবদুল লতিফ খান, দাদা জান আলী খান, মাতা ওয়াহাবুন্নিসা চৌধুরী। এ কে খানের পিতা শিক্ষিত, ধার্মিক ও সরকারি চাকুরিজীবী ছিলেন। ফলে এ, কে, খানও শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে বিচারকের চাকরি গ্রহণ করেন। অর্থাৎ সেকালের মুন্সেফ একালের সহকারী জজের চাকরি গ্রহণ করেছিলেন। দাম্পত্য জীবনে পা বাড়ানোর পর শ্বশুরের অনুপ্রেরণায় শিল্প ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে ধারণাতীত সাফল্য লাভ করে এগিয়ে যান। পরবর্তীতে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন।
এ, কে, খান ফতেয়াবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১ম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১ম বিভাগে আই, এ পাস করেন। শুধু তাই নয় তখন তিনি চট্টগ্রাম বিভাগে ১ম স্থান অধিকারী ছিলেন এবং মহসিন বৃত্তিলাভ করেন। ১৯২৭ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি.এ (অনার্স) ডিগ্রী নেন। ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বি.এল পরীক্ষায় ১ম শ্রেণীতে ২য় স্থান লাভ করেন। পরে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বাঙালি মুসলমান পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ১ম হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম.এ পাস করেন ১ম বিভাগে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, এ, কে, খান একজন মেধাসম্পন্ন ছাত্র হিসেবে প্রায় সব পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর পর কিছুদিন কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করেন। এতে তিনি শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকের জুনিয়র হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। সিভিল সার্ভিস (বিচার বিভাগীয়) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৩৪ সালে মুন্সেফ (সহকারী জজ) চাকরি গ্রহণ করেন। সে সময় বরিশালে সহকারী জজ থাকাকালে এক মামলায় জনৈক ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তাকে শাস্তিদান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
ব্রিটিশ ভারতে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত শিপিং লাইন সহ নানান ব্যবসায়ী আবদুল বারী চৌধুরী, যিনি বার্মায় (বর্তমান মায়ানমার) অবস্থানকারী প্রতিপত্তিশালী ব্যবসায়ী ছিলেন। শুধু তাই নয় তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে বিখ্যাত বেঙ্গল বার্মা স্টীল নেভিগেশন কোম্পানির মালিক। এই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব আবদুল বারী চৌধুরী চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা। তারই কন্যা শামসুন্নাহার বেগমের সাথে এ, কে, খানের বিয়ে হয় রাজকীয় জাঁকজমকের সাথে। রেঙ্গুনে (বর্তমানে ইয়াঙ্গুন) এ বিয়ে উপলক্ষে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান আজও অতি বয়স্কজনের কাছে স্মরণীয়।
দাম্পত্য জীবনে পা বাড়ানোর পর এ, কে, খান, শ্বশুর আবদুল বারী চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে ব্যবসার দিকে পা বাড়ান ১৯৪৪ সালে। ইতিপূর্বে ব্রিটিশ-জাপান যুদ্ধে জাপান মায়ানমার সাময়িক অধিকার করে নিলে প্রতিকূল অবস্থাহেতু আবদুল বারী চৌধুরী যতটুকু সম্ভব অর্থ সম্পদ নিয়ে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। চট্টগ্রামে এসে আবদুল বারী চৌধুরী তার জামাতা মেধা সম্পন্ন এ, কে, খানকে ব্যবসা-বাণিজ্যে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করেন। এ কে খানও শ্বশুরের পরামর্শে ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে নিজেকে আত্ননিয়োগ করেন। পরবর্তীতে নিজেকে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে নেন। ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে মুসলিম লীগে যোগ দেন। তিনি তৎকালে চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগের সদস্য এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পি.আই.এ) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে ভারতীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। তবে কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নির্দেশে সংসদে যোগদান থেকে বিরত হন। পরবর্তী বছর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আইন সভার সদস্য হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক প্রধান আইয়ুব খান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ করার পর আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভায় তিনি যোগদান করেন।
এ, কে, খান শিল্প, পূর্ত, সেচ, বিদ্যুৎ ও খনিজ মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। তার আমলে পাক-ভারতের মধ্যে সিন্ধু পানি বন্টন চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে বস্ত্র ও পাট শিল্পে দ্রুত প্রসার লাভ করে। চট্টগ্রাম স্টীল মিল, কর্ণফুলী রেয়ন মিল তারই প্রচেষ্টার ফসল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আমরা এ বিখ্যাত স্টীল মিলটি রক্ষা করতে পারলাম না। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে প্রতি জেলায় শিল্পকারখানা স্থাপনে ভূমিকা রাখতে তৎপর ছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। চার বছরের ব্যবধানে ১৯৬২ সালে তিনি পদত্যাগ করেন। ঐ বছর সংবিধান রচনায় মূল্যায়নে অবদান রয়েছে তাঁর। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলীয় সদস্য ছিলেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সংকট নিরসনে রাজনৈতিক সমাধানের আশায় এয়ার মার্শাল আজগর খানের তেহরিক ইশতেকলাল পার্টিতে যোগদান করেন।
১৯৪৪ সালে সহকারী জজের চাকরি অব্যাহতি দেয়ার পর ব্যবসা-বাণিজ্য মনোনিবেশ করে অসাধারণ সাফল্য লাভ করেন। দেশের শিল্প জগতে তার অবদান স্মরণযোগ্য। ১. ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামে তিনি প্রথম এ, কে, খান ম্যাচ ফ্যাক্টরী স্থাপন করেন। পরবর্তীতে আরও প্রতিষ্ঠা করেন। ২. এ. কে খান প্লাই উড কোং লিঃ ৩. এ কে খান লেদার এন্ড সিনথেটিঙ ইঞ্জিনিয়ারিং লি. ৪. চিটাগাং টেঙাটল মিলস লি. ৫. এ, কে, খান জুট মিল লি. ৬. এ, কে, খান ডকিং এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লি. ৭. খান-এলিন কর্পোরেশন ৮. বেঙ্গল ফিশারিজ লি. ৯. এস.টি. এম লি. (স্পেশালাইজড) টেঙটাইল মিলস লি. ১০. টোটাল থ্রেড (বিডি) লি. ১১. পাকিস্তান স্টিল নেভিগেশন কোম্পানি।
তার শিল্প কারখানায় শ্রমিক-মালিক সু-সম্পর্কের আদর্শ স্থাপিত হয়। শ্রমিক অসন্তোষ দূরীকরণের জন্য শিল্পে শ্রমিকের শেয়ার প্রদানের পক্ষপাতি ছিলেন তিনি।
১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সারা পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে দু’টি সিট বাদে বাকি সমস্ত সিট আওয়ামী লীগ পায়। এতে শতভাগ নিশ্চিত আওয়ামী লীগই সমস্ত পাকিস্তানের সরকার গঠন করবে। পূর্ব পাকিস্তানে অনেকে আওয়ামী লীগ না করে অন্য পার্টি করত। এমনকি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে হেরে গেলেও সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকতে কিছু লোক বাদে অনেকেই আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পক্ষে জোরালো সমর্থন জানায়। অনুরূপভাবে এ, কে, খান আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পক্ষে জোরালো মত প্রকাশ করতে থাকেন।
১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তান বাহিনী এদেশের নীরহ জনগণের উপর লোমহর্ষক নিধনযজ্ঞ শুরু করে। এ অবস্থায় এ, কে, খান মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেন। তিনি চট্টগ্রাম মহানগরীর বাটালী হিলস বাসভবন ছেড়ে ফটিকছড়ি চলে যান। পাক বাহিনী দ্বারা এ.কে খান বাংলো বাড়িসহ শিল্প কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
তিনি শিল্প ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি জনকল্যাণে সেবাদান করে গেছেন। রোটারী ক্লাবের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, ছিলেন জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি। এ প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম পাহাড়তলীতে চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে। সায়েন্টিক কমিশনের সভাপতি ছিলেন। চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের সহযোগী ছিলেন; জনকল্যাণে তথা স্বাস্থ্য শিক্ষাখাতে সেবার জন্য এ, কে, খান ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন।
এ, কে, খান ছিলেন সৎ, ধার্মিক, ন্যায়নিষ্ঠ, পরিশ্রমী। এ মহান ব্যক্তিত্ব ১৯৯১ ইংরেজির ৩১ মার্চ ৮৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। লালদীঘির ময়দানে নামাজে জানাজার পর বাটালি হিলস্থ পাহাড়ের মসজিদ সংলগ্ন তাকে সমাহিত করা হয়। আল্লাহ পাক তাকে পরকালে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক। আমিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধে দেশপ্রেম
পরবর্তী নিবন্ধমৌসুমী-সানির ছেলের বিয়ে ভাইরাল নতুন বউয়ের ছবি