আশির দশকে বাঙলা সঙ্গীতের জগতে ব্যাপকভাবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা সংযোজন ব্যান্ড সঙ্গীত। নব্বই এর দশকে যা জোয়ারে পরিণত হয়। তৎকালীন তরুণদের মাঝে তা অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও প্রবীন আর ধ্রুপদ কুলীনদের মাঝে ব্যান্ড ইস্যুতে জাত গেল রবটি নব্বই দশকের অতি পরিচিত বাস্তবতা। তাদের বেশীরভাগ অংশই সেই সময়ে ব্যান্ড ব্যাপারটিকে উছৃংখলতা আর লাফালাফি সমৃদ্ধ নান্দনিকতাহীন একটি চর্চা বলেই মনে করতেন।
এ প্রসঙ্গে নব্বই এর দশকের মাঝামাঝিতে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক এর উপস্থাপনায় বিটিভিতে প্রচারিত জলসা নামের একটি বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠানের স্মৃতি বারবার হৃদয়ে অনুরণন তুলছে। ১৯৯৫ সালে প্রচারিত অনুষ্ঠানটিতে আনিসুল হক ব্যান্ড তারকাদের দিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, পল্লী গীতি এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গাইয়েছিলেন। অন্যপ্রান্তে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, নিলুফার ইয়াসমিন, সুবীর নন্দী, কলিম শরাফীর কন্ঠে তুলে দিয়েছিলেন জনপ্রিয় ব্যান্ডের গানগুলো। গানের ফাঁকে ফাঁকে আলাপচারিতায় ছিলেন নকীব, পার্থ, মাকসুদ, হামিনদের মতো ব্যান্ড তারকারা আর খান আতা, মোস্তফা মনোয়ার, কলিম শরাফী, প্রফেসর অবদুল্লাহ আবু সাইয়েদ এর মতো প্রবীণ শিল্প ব্যাক্তিত্বরা। তাদের আলাপচারিতায় খুব স্পষ্টভাবে উঠে এসেছিলো ব্যান্ড তারকাদের আত্নরক্ষার চেষ্টা আর প্রবীণদের মধ্যে ‘কোনভাবেই গ্রহণ করবো না’ এই মানসিকতার প্রতিফলন। অবশ্য কলিম শরাফী কিছুটা এবং খান আতা স্পষ্টভাবেই তরুণদের পক্ষ নিয়ে নিজেদের কালোত্তীর্ণ পরিণত মনস্তত্ব এর পরিচয় দিয়েছিলেন। সেই বির্তকের ২৫ বছর পর সমকালীনতায় প্রপঞ্চগুলোর পর্যবেক্ষণ এই লেখার অভিপ্রায়।
একটু ধারণা নেয়া যাক একটি ব্যান্ড কীভাবে একটি গান তৈরি করে। একজন একক শিল্পী সাধারণত একটি গান সংগ্রহ করেন- কাউকে দিয়ে সুর করান, ষ্টুডিওতে গিয়ে কম্পোজ করেন, তারপর পরিবেশন করেন। ব্যান্ডে একটি গান তৈরি করে একটি দল। ব্যান্ডকে আমি তুলনা করবো থিয়েটার এর সাথে যেখানে টিকেট বিক্রেতা থেকে অভিনেতা পর্যন্ত সবাই একটি দলবদ্ধ চর্চার ভেতর থাকেন এবং সমন্বিত প্রক্রিয়ায় কাজ করেন। গান লেখা, সুর করা, কম্পোজ করা, পরিবেশন করা সবটাই সকলের মতামত এবং সর্বোত্তম যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়েই সম্পাদিত হয় যা শুধু দলীয় অংশগ্রহণেই সম্ভব। সংঘবদ্ধ অংশগ্রহণ পুরো কাজটিকে শক্তিশালী একটি মাত্রায় নিয়ে যায়। নিঃসন্দেহে তা একক মাত্রার চেয়ে দৃঢ়। মঞ্চ নাটকে আমরা একই চরিত্র অনেকের অভিনয়েই দেখি- ব্যান্ডেও তেমন হয়। সোলস এর ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গানটি ৪২ বছরে কত ঢং-এ কতজনের কন্ঠে আমরা শুনেছি- একটু মনে করে দেখি। গানটা নিয়ে আজও নীরিক্ষা হয়। ব্যান্ডের অনেক গান নিয়েই হয়।
এখন ইউটিউবের সময়। এই সময়ে কোন গান শুনতে গেলে প্রথমেই ইউটিউব খুলে বসি। ইন্টারনেটের কল্যাণে আমরা এখন সহজেই ইউটিউবে উপভোগ করতে পারি সারা বিশ্বের সঙ্গীত এবং পরিচিত হতে পারি সারা বিশ্বের বাদ্যযন্ত্রের সাথে। পশ্চিম আফ্রিকার কোরা আর পর্তুগীজ উকুলিলির মত বিশ্বমাঠে নানা প্রান্তে প্রচলিত নানা যন্ত্রের মধ্যে যে ভিন্নতার স্বাদ এবং তা নিজ সংস্কৃতির সাথে সংমিশ্রন করার যে মুন্সীয়ানা তা কিন্তু এ-দেশে ব্যান্ড এর মানুষেরাই দেখিয়েছে। অথচ আবদ্ধ প্রবীণদের মানসিক স্থিতি জড়তা তার স্বীকৃতি দিতে চায়নি কোনভাবেই কোনকালেই। একদল মানুষের স্থিত মনস্তত্ব কোনভাবেই পরিবর্তন বা রূপান্তরের ধারাকে স্বাগত জানাতে পারে না। কম্পিউটার বিপ্লবের পর টাইপ রাইটার আঁকরে থাকা এইরূপ মানুষেরা চিরচেনা জগতের বাইরে কখনোই নতুন কিছু চিনতে পারে না। এজন্যই নব্বই দশকের আবদ্ধজনদের মাঝে ফরাসী হারমোনিয়াম কে নিজের মনে করার প্রবণতা ঠিকই ছিল- কিন্তু ব্যান্ডকে তারা মেনে নিতে পারতেন না তা সমকালীন বলে। আর তা হয়েছিলো তাদের বেড়ে ওঠার সামাজিকীকরণের মধ্যে তা ছিলনা বলে।
সেই সময়ের বুদ্ধিজীবীদের একটি স্থির ধরণা ছিল- এইসব সঙ্গীত সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যাবে। সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুই আসে এবং অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। এটা সত্য এবং সবার ক্ষেত্রেই সত্য। বহু ধ্রুপদ গানের চর্চাকারীরা হারিয়ে গেছেন। হারিয়ে গেছে যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা ব্যান্ডগুলো। সেগুলো আমি গণনায় আনতে চাইনা। কিন্তু সত্তর বা আশির দশকের ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘হৃদয় কাদা মাটির মূর্ত্তি’ নয় অথবা ‘পাথুরে নদীর জলে’ আমরা এখনো শুনি। গানগুলি হারায়নি। এই সময়ে এসে নিশ্চিত করে বলা যায় এগুলো টিকে আছে এবং থাকবে- যেমনটা খান আতা বলেছিলেন।
সময়ে সম্পদ কোনটি তা শুধু সময়োত্তীর্ণরাই উপলব্ধি করতে পারে। তাদের দূরদৃষ্টি যথার্থ প্রমাণ করেই এখনো মাইলস, ফিডব্যাক, সোলস টিকে আছে, নিজ রঙ-এ উজ্জল নান্দনিক ধ্রুপদ হয়েই। সময়ের বিবর্তনে স্বমহিমায় টিকে থেকে এই ধারাটি নিজেদের স্বকীয়তা এবং নান্দনিকতাই প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশী ব্যান্ডের গান আমরা কিন্তু উপমহাদেশের অন্যত্র এবং উপমহাদেশের বাইরেও নকল হতে দেখেছি। ব্যান্ডের গান ব্যবহৃত হয়েছে টিভি নাটকে, চলচ্চিত্রে। বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের প্রচারে, সমাজ পরিবর্তনের ইস্যুতে রেডিও-টিভি স্পটের মধ্যেও আমরা দেখেছি এর ব্যবহার। আমাদের ব্যান্ড তারকা নিজ ঢং-এ ভারতীয় বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রেও গান করেছেন। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসে আমরা বলতেই পারি আমাদের ব্যান্ড সঙ্গীত এখন আমাদের নিজস্ব একটি ঘরানা।