দেশের সবচেয়ে বড় সেবাখাতগুলোর একটি চিকিৎসা সেবা। কিন্তু এই সেবাখাতের সেবা কতটুকু নিশ্চিত হচ্ছে এখনো পর্যন্ত? কোভিড-১৯ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে কতটা নাজুক স্বাস্থ্যসেবা আমাদের। তারপরও এই ভঙ্গুর এবং দুর্বল স্বাস্থ্যখাত নিয়ে যেভাবে করোনা মহামারীর মোকাবেলা করছে সরকার ও চিকিৎসকরা, তা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে প্রশ্ন হলো আমাদের দেশে সেবার মহান ব্রত নিয়ে যারা ডাক্তারি পেশায় জড়িত তারা কতটা সেবা বান্ধব?
দেশের অধিকাংশ মানুষ গরিব, অসহায় কৃষক ও দিনমজুর। এখনো দেশে ৪০.৬% কৃষিখাতে জড়িত। দরিদ্র এবং হত দরিদ্রের হার ৩০ উর্ধ্ব। কোভিড-১৯ যে এই হার আরো বাড়াবে তাও অস্বাভাবিক নয়। আর এদের দৈনিক ৩০০-৫০০ টাকা বা তার কিছু বেশি আয়ে চলে দৈনন্দিন জীবন। দেশে নিত্যপণ্যের দাম যে হারে উর্ধ্বগতি, তাতে এই দিনবদলা মজুরি নিতান্তই মামুলি ঠেকে। তবুও দিন চলে যাচ্ছে, জীবন যাপিত হচ্ছে। কিন্তু এই স্বল্প আয়ের মানুষেরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আর স্বাস্থ্য বিষয়ে অজ্ঞতার দরুন অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছে হরহামেশাই। দেশে জেলা-উপজেলায় সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা থাকলেও তা রোগীর তুলনায় খুবই অপ্রতুল এবং সেইসাথে অব্যবস্থাপনায় ভরপুর। আবার সরকারি হাসপাতালে বিজ্ঞ ডাক্তাররা রোগী দেখার নির্দিষ্ট সময়ের পরে আর হাসপাতালে থাকেন না, পরবর্তী সময়ে নিজস্ব চেম্বার অথবা প্রাইভেট ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন।
তখন জরুরি প্রয়োজনে যথাযথ চিকিৎসা শঙ্কায় রোগীদের বাধ্য হয়ে ঝুঁকতে হয় বেসরকারি হাসপাতাল অথবা ডাক্তারের নিজস্ব চেম্বারে। কিন্তু সেখানে গেলেই তাদের গুনতে হয় মোটা অঙ্কের ডাক্তারি ভিজিট ফি। যে ফি রীতিমতো চোখ কপালে উঠার মত। যে দিনবদলা একজন শ্রমিক সারাদিনে আয় করেন ৩’শ থেকে ৫’শ, তাকে ডাক্তারের চেম্বারে বা বেসরকারি হাসপাতালে গেলে শুধুমাত্র ডাক্তারের ভিজিটই দিতে হয় ৮০০, ১০০০ থেকে শুরু করে ১২০০ টাকারও উর্ধ্বে। ঔষধ আর আনুষাঙ্গিক বিষয়তো আরো পরে। অন্যদিকে, ডাক্তাররা আজকাল পরীক্ষা ছাড়া কোন ঔষধই দেন না। তাও ছোটখাটো কোন পরীক্ষাতে তারা ক্ষান্ত নন, হাজারটা পরীক্ষা দিয়ে বসেন, পরীক্ষাগুলোও করতে হয় তাদের পছন্দমতো ল্যাবে। নয়ত রোগীর উপর রেগে গিয়ে ঝাড়ি দেন। এতকিছুর পরে প্রেসক্রিপশনের ওষুধও কিনতে হয় তাদেরই রেফারেন্স করা কোম্পানির। এটি কি একরকম সেবার নামে ব্যবসা নয়? অথচ দেখার কেউ নেই! এতকিছু মেনে নিয়েও রোগীরা চিকিৎসা করে দেখা যায় চিকিৎসকদের ভুলে অর্থাৎ ভুল চিকিৎসায় অনেক রোগীর প্রাণ চলে যায়। আবার সেই মৃত রোগী ছাড়াতেও লাগে টাকা। মাঝেমধ্যে কেউ মানতে না পেরে প্রতিবাদ করলে ডাক্তার, কর্মচারী সবাই মিলে একযোগে চলে যান অনশনে। বন্ধ করে দেন চিকিৎসা। দিনশেষে সাধারণ মানুষ একধরনের জিম্মিই যেন ডাক্তারদের কাছে। আবার দেখা যায়, পূর্বে চিকিৎসা করা কোন চিকিৎসকের পর নতুন কোন চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসার জন্য গেলে, পূর্ববর্তী চিকিৎসক হয়ে যান আনকোরা, অদক্ষ এবং অযোগ্য। যেন ওনার উপরে কোন চিকিৎসকই হতে পারেন না। তখন রোগীকে পূর্ববর্তী সকল পরীক্ষার রিপোর্ট থেকে শুরু করে ঔষধপাতি সবই বাদ দিয়ে নতুন করে আবার ওই চিকিৎসকের পছন্দমতো সব করতে হয়। এ যেন সুনিপুণতায় সাজানো এক টাকার খেলা।
তবুও আমার দেশের মানুষ ডাক্তারদের বড্ড ভালবাসেন এবং খোদার পরে জীবন বাঁচানোর জন্য একজন অন্যতম উছিলা ভেবে শ্রদ্ধা করেন। তাছাড়া কোভিড-১৯ এর এই দুঃসময়ে নিঃসন্দেহে আমার দেশের চিকিৎসকদের কৃতিত্ব স্বীকার করতেই হয়। অকুতোভয় বীরের মতো সেবা দিয়ে গেছেন দেশের মানুষকে। তবুও দিনশেষে কিছু আফসোস পিছু ছাড়ে না। রোগীদের অহেতুক টেস্ট দেওয়া বন্ধের পাশাপাশি ডাক্তারের ভিজিট সবচেয়ে কমে নামিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি। নয়ত দেখা যায় অনেক অসহায় ও স্বল্প আয়ের মানুষ এই মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি প্রত্যাশা করছি।