বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) জন্মলগ্নে দেশে পেট্রোলিয়াম জ্বালানির চাহিদা ছিল ১১ লক্ষ মেট্রিক টন। ৪৫ বছরের ব্যবধানে বর্তমানে চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬ লক্ষ মেট্রিক টনে। শুরুর হাজার কোটি টাকার বার্ষিক টার্নওভার বেড়ে এখন হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। সময়ের ব্যবধানে কাজের পরিধি কয়েক গুণ বাড়লেও জনবল বাড়েনি। বরং দিনে দিনে কমেছে জনবল। ফলে বর্তমানে তীব্র জনবল সংকটে ধুঁকছে দেশের জ্বালানি বিপণন ও নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অধীন। দীর্ঘ সময় ধরে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সময়ক্ষেপণের কারণে বিপিসিতে প্রয়োজনীয় জনবল কাঠামো গড়ে উঠেনি। অথচ বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরে এলে সমস্যাটি অনেক আগেই সমাধান হয়ে যেত।
সূত্র জানিয়েছে, ১৯৭৭ সালে ২০৯ জনের জনবল কাঠামো দিয়ে বিপিসি কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৮৪ সালে এরশাদের মার্শাল ল’ কমিটি বিশেষ পরিপত্র জারি করে ১৭৭ জনে নামিয়ে আনে। পরে কয়েক দফা জনবল নিয়োগ হলেও বর্তমানে মাত্র ১২৮ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। বর্তমানে ৫০টি পদ খালি রয়েছে। এর মধ্যে ৫৯ জন কর্মকর্তার মধ্যে ১৭টি পদ এবং ১১৯ জন কর্মচারীর মধ্যে খালি রয়েছে ৩৩টি পদ। অথচ নিয়ন্ত্রণাধীন বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনবল বেড়েছে। দেশে জ্বালানি তেলের পুরোটাই আমদানি করতে হয়। অপরিশোধিত ও পরিশোধিত এসব জ্বালানি আমদানি করে দেশীয় রিফাইনারির মাধ্যমে পরিশোধন ও দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বাজারজাত করে বিপিসি। বর্তমানে বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন সাতটি তেল স্থাপনা ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব স্থাপনা থেকে সারা দেশে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এদিকে বিপিসির সক্ষমতা বাড়াতে ২০১২ সালে ৪১১ জনের জনবল প্রয়োজন উল্লেখ করে নতুন জনবল কাঠামো পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে। ওই বছর মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটির ওপর নানা পর্যবেক্ষণ লিখে বিপিসিকে ফেরত পাঠায়। ৯ বছরেও নতুন করে জনবল কাঠামো তৈরি করতে পারেনি বিপিসি। তবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের পর্যবেক্ষণ অনুসারে নতুন করে জনবল কাঠামো তৈরির পদক্ষেপ নিয়েছে বিপিসি। চলতি সপ্তাহে এ নিয়ে প্রধান কার্যালয়ে বৈঠকে বসছেন বিপিসির শীর্ষ কর্মকর্তারা।
জনবল সংকট থাকায় পদায়িত কর্মকর্ত-কর্মচারীদের ওপর কাজের চাপ বেড়েছে। শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ, কাজের চাপে অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে গত কয়েক বছরে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কয়েকজন শ্রমিক-কর্মচারী মৃত্যুবরণ করেছেন। আবার অতিরিক্ত চাপ নিতে না পারায় নির্ধারিত সময়ের আগে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর অনেক কর্মচারী স্বেচ্ছায় অবসরে গেছেন। যে কারণে জনবল সংকট আরো তীব্রতর হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে পদোন্নতি নিয়েও রয়েছে জটিলতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ১৯৮৯ সালে বিপিসিতে চাকরি প্রবিধানমালা তৈরি হয়। ওই প্রবিধানমালাও ছিল ত্রুটিপূর্ণ। প্রবিধানমালা অনুযায়ী ৫০ শতাংশ পদোন্নতি দিয়ে এবং ৫০ শতাংশ সরাসরি নিয়োগ দিয়ে শূন্যপদ পূরণ করতে হবে। পদোন্নতির নানা ইস্যুতে অস্পষ্টতার কারণে পদোন্নতি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। তাই চাইলেও পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব হয় না।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, বিপিসি দেশের জ্বালানি কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ জটিলতার কারণে দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটিতে। গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোতে কর্মকর্তার অভাব রয়েছে। অপারেশন, বিপণন, বাণিজ্য, পরিকল্পনা, প্রশাসনিক শাখায় আরো জনবল প্রয়োজন। ইস্টার্ন রিফাইনারি, পদ্মা অয়েল কোম্পানি, যমুনা অয়েল ও মেঘনা পেট্রোলিয়াম থেকে ধারে এনে চলছে পরিকল্পনাসহ কয়েকটি বিভাগ। প্রতিষ্ঠানটিতে নতুন জনবল নিয়োগ দেওয়া না হলে জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় সংকট তৈরি হতে পারে।
এ ব্যাপারে বিপিসির চেয়ারম্যান ও সরকারের সচিব আবু বকর ছিদ্দীক গতকাল আজাদীকে বলেন, পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনে জনবলের সংকট দীর্ঘদিনের। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে জনবল কাঠামো গড়ে উঠেনি। নিয়োগ, পদোন্নতিতে জটিলতা রয়েছে।
তিনি বলেন, দেশ এগিয়েছে, অর্থনীতির পরিধি বাড়ছে। এতে দিন দিন বাড়ছে জ্বালানির চাহিদা। ফলে বিপিসির কাজের পরিধিও বেড়েছে। জনবলের সংকট থাকার কারণে বিপিসির কার্যক্রম অনেক সময় সুচারুভাবে এগুচ্ছে না। নতুন করে জনবল কাঠামো তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সাথে বিষয়টি সমন্বয় করা হচ্ছে।