বাংলাদেশ অর্থনীতির উত্তরণ এবং এর চ্যালেঞ্জসমূহ

প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য | বৃহস্পতিবার , ১৮ মার্চ, ২০২১ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

একটি দেশের জনগণের জীবন প্রবাহ উন্নত ও আরামদায়ক করার জন্য এবং ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা দূর করে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে গতিশীল করার জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজন হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিভাজনে প্রাথমিকভাবে একটি দেশকে বলা হতো হয়তো উন্নত, না হয় অনুন্নত। কিন্তু অর্থনীতির জটিল তত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে বর্তমানে অর্থনীতিকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- স্বল্পোন্নত দেশ, উন্নয়নশীল দেশ এবং উন্নত দেশ। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। তবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া খুবই দীর্ঘ। একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কিনা তা মূল্যায়ন করে জাতিসংঘের একটি শাখা। এ শাখাটির নাম হয়- ‘কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। এ কমিটি তিনটি সূচকের বিচার বিশ্লেষণ করে একটি দেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। এ তিনটি সূচক হয়- মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। এখানে উল্লেখ্য যে, উক্ত কমিটির সদস্য হয় বাংলাদেশের সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডাইলগ) এর বিশেষ ফেলো শ্রদ্ধেয় দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ করতে প্রায় ছয় বছর সময় লাগে।
উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে প্রথমে তিনটি সূচকের দুইটিতে নির্ধারিত মান অর্জন করতে হয়। তবে এ মান সব সময় এক থাকে না। এটি পরিবর্তন করা হয়। উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হওয়ার আর একটি উপায় আছে। কোন দেশের নির্ধারিত মাথাপিছু আয় যদি দ্বিগুণ হয়ে যায় তবে সেই দেশটি উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হতে পারে। আর যদি তিনটির মধ্যে দুইটিতে মান অর্জন করে তবে একটি দেশকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছে বলে মনে করা হয়। তিন বছর পর পর এ মূল্যায়ন করে সিডিপি। তিন বছর পরের মূল্যায়নে ঐ সূচকগুলোতে ধারাবাহিকতা থাকলে অর্থাৎ তিনটির মধ্যে অন্তত দুইটি মান অর্জন করলে চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সুপারিশ করে সিডিপি।
আরো তিন বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ সভায় দেয়া হয় উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার চূড়ান্ত অনুমোদন। ২০১৮ সালে প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। কাজেই ২০২১ সালে চূড়ান্ত সুপারিশ পেলে নিয়ম অনুযায়ী ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাবে।
জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সুপারিশ করার জন্য বিশ্বের পাঁচটি দেশকে তালিকায় রেখেছে। ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য সভায় ত্রিবার্ষিকী মূল্যায়ন করবে জাতিসংঘের ‘কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)’। এ তালিকায় বাংলাদেশ ছাড়াও আছে নেপাল, মিয়ানমার, লাওস ও তিমুর লেসেথো। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটার সাথে সাথে বাংলাদেশকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। শুল্কসহ আমদানিকারক দেশের হিসাব অনুযায়ী ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন বছরে বাংলাদেশের গড় রপ্তানি ছিল ৪ হাজার ২১৪ কোটি ডলার। তার মধ্যে ৫৮ শতাংশের গন্তব্য ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ শতাংশ, কানাডা ও জাপানে ৩ শতাংশ করে এবং অষ্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত, রাশিয়া ও তুরস্কে ২ শতাংশ করে রপ্তানি হয়। আর রপ্তানিতে শীর্ষে থাকা ১২টি পণ্যের প্রথম ১১টি হচ্ছে পোশাকের বিভিন্ন আইটেম। বাকি একটি হচ্ছে জুতা। সব মিলিয়ে পণ্য রপ্তানির ৭৬ শতাংশই এ ১২ খাত থেকে এসেছে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) হিসাব অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটলে বাংলাদেশের ৪৮৪ কোটি ডলারের পোশাক, ১৮ কোটি ডলারের বস্ত্র, ১৬ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ১১ কোটি ডলারের মাছ ও হিমায়িত খাদ্য রপ্তানি কমবে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) হারাবে। বর্তমানে তৈরি পোশাকের ৬২ শতাংশ পণ্য ইইউ এর বাজারে শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশ করে। এ কারণে ইইউ এর বাজারে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা নিজদের অবস্থান দৃঢ় করেছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলেও পরের তিন বছর ইইউতে জিএসপি সুবিধা পাওয়া যাবে। তারপর জিএসপি প্লাসের অন্তর্ভুক্ত হতে না পারলে ইইউ এর বাজারে প্রবেশ করতে হলে ১২টি পণ্য (পোশাক ও জুতা খাত) রপ্তানিতে প্রায় ১০ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে। এর ফলে ইইউতেই ৫২৮ কোটি ডলারের রপ্তানি কমে যেতে পারে। তার মধ্যে তৈরি পোশাকই হবে ৪৮৫ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ হবে ৪১ হাজার ২২৫ কোটি টাকার সমান। তাছাড়াও ভিয়েতনাম ও ইইউ এর মধ্যে এফটিএ (মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল) হওয়ায় ইইউ এর বাজার পোশাক রপ্তানি করা বাংলাদেশের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। এলডিসি হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশকে পণ্য রপ্তানিতে ইইউ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, জাপান, তুরস্ক ও কানাডা শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। এর বাইরে রাশিয়া ও বেলারুশ ৭১টি পণ্যে তাদের জিএসপির (জেনারালাইজ সিষ্টেমস অব প্রেফারেন্স) আওতায় বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলে ইইউ ছাড়াও কানাডা, জাপান, কোরিয়া, চীন ও নিউজিল্যান্ডের রপ্তানি বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কারণ তখন শুল্কমুক্ত সুবিধা বলবৎ থাকবে না। নিয়মিত শুল্ক দিয়েই পণ্য রপ্তানি করতে হবে। সেই হিসেবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে কানাডার বাজারে বাংলাদেশের ১২টি শীর্ষ রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ১০টিতেই ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ শুল্ক ও কর দিতে হবে। তাতে ৫৩ কোটি ৬১ লাখ ডলারের রপ্তানি হারানোর শঙ্কা রয়েছে। এ পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৪২ শতাংশ। একইভাবে জাপানের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে ৮ থেকে ১১ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। এতে রপ্তানির পরিমাণ কমতে পারে ৩৮ কোটি ৮১ লাখ ডলারের যা মোট রপ্তানির ৩০ শতাংশের মতো। অনুরূপভাবে কোরিয়া ও চীনে রপ্তানি হ্রাস পাবে।
তবে নেতিবাচক বিষয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য সুখবরও দিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে বাংলাদেশ যদি উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর হয় তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি ৭.৩৪ শতাংশ বা ৪৪ কোটি ডলারের রপ্তানি বাড়তে পারে। শ্রমিক ইস্যুতে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের জিএসপি (জেনারালাইজ সিস্টেমস অব প্রেফারেন্স) সুবিধা স্থগিত করে মার্কিন সরকার। এখানে উল্লেখ্য যে, ইইউ (ইউরোপীয় ইউনিয়ন) তা স্থগিত করেনি। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ছিল ৪৯৪ কোটি ডলারের।
তারপরেও ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৫৯৩ কোটি ডলার হয়। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি ১০ কোটি ডলার এবং অস্ট্রেলিয়ায় ৭ কোটি ৫৮ লাখ ডলারের রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর বাংলাদেশের রপ্তানি সুবিধা ছয় বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকতে পারে। উন্নয়নের গতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সরকারকে এ সুবিধা ১০ বছরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাতে হবে। তবেই বাংলাদেশে উন্নয়ন গতির ক্রমবর্ধমানতা বজায় থাকবে।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, আমাদের অর্জন এবং নানা প্রসঙ্গ
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল