বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে সরাসরি যোগ দেওয়ার জন্য অনেক বিদেশি অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতির কারণে সব ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের নতুন পুনর্বিন্যাস করা হয়। তাই বলে আনন্দ উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। বিজ্ঞানের বিষ্ময়কর অবিষ্কারের ফলে টুইটার বার্তার ও ভিডিও বার্তার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালনের উৎসবে ব্যাপকতা লাভ করে। এক টুইটার বার্তায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের হয়ে থাকবেন বঙ্গবন্ধু। নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্য দেবী ভান্ডারী, ভূটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং ওআইসির মহাসচিব ইউসুফ বিন আহমেদ আল থাইমনি এক ভিডিও বার্তার মাধ্যমে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ভূঠানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং শুভেচ্ছা জানান। তিনি এক হাজার (১০০০) ‘ঘি প্রদীপ’ জ্বালিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিদেহী আত্নার শান্তির জন্য প্রার্থনা করেছেন। দেশেই শুধু নয়, ইউনিসেফ এর উদ্যোগে সমগ্র বিশ্বে মুজিব বর্ষ উদযাপন করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সেই দিন ১৭ মার্চ ২০২০ সকাল ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে পুষ্প অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করেন। বিউগলের সুর বাজানো হয়। গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। ১৭ মার্চ ২০২০ভোর থেকেই ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়িতে জনতার ঢল নামে। আওয়ামীলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানান। বঙ্গবন্ধুর নামে নানা স্লোগানে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু – স্লোগানটি ১৯৭১ এর স্মৃতিকে বার বার রোমন্থন করছিল। এই একটি স্লোগান সেইদিনে সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অনুপ্রেরনার উৎস। ‘এক নেতার, এক দেশ-’ এই স্লোগানটি ১৯৭১ এর মুক্তি সংগ্রামে আপামর জনতাকে একটি বিন্দুতে নিয়ে আসে। আলোর ঝরনাধারায় শুরু হয়েছিল মুজিব বর্ষ। রাত আটটায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘মুক্তির মহানায়ক’ শিরোনামে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ১০ জানুয়ারি ২০২০ থেকে শুরু হয়েছিল মুজিব বর্ষের কাউন্টডাউন (ক্ষণগণনা)। এই ক্ষনগণণা উপলক্ষে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরসহ বড় বড় শহরগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে ঘড়ি স্থাপন করা হয়। জন্মের শতবর্ষ পরে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে বিনম্র শ্রদ্ধায় বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হয় ১৭ই মার্চ ২০২০। পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতাচিত্তে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হবে আগামী ২৬মার্চ ২০২১ সাল পর্যন্ত। জাতীয় সংসদ ভবনের সব প্রবেশ পথেই ছিল মুজিব শতবর্ষের ছোঁয়া। দক্ষিণ গেটে মুজিব শতবর্ষের বিশাল আকৃতির একটি লোগো বসানো হয়েছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি এই বিশেষ দিনটিকে নিজেদের জীবনে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই অনেকে ছবি তুলেছেন। রাসেল স্কয়ারে বানানো হয়েছে একটি বিশাল তোরণ। বঙ্গবন্ধু যাদুঘরটি সাজানো হয়েছে বিশেষ বিশেষ মুহূর্তের আলোকচিত্র দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ কোটপিন বিক্রয় হয়েছে। বিজয় স্মরণিতে স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর তর্জনী উঁচিয়ে ভাষণ দেওয়ার এক বিশাল প্রতিকৃতি, যেখানে স্থানপায় বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণের উক্তিগুলো। ১৯২০ সালের রাত ৮.০০টায় বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল। রাত ৮.০০টায় ১০০ পাউন্ডের কেক কেটে জন্মদিন পালন করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আতশবাজী ফুটানো হয়, ফানুস উড়িয়ে ও আতশবাজিতে দেশব্যাপী জন্মদিন পালন করা হয়। ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান ডেভেলাপমেন্ট (আইএইচডি) ব্যতিক্রমীকর্মসূচি গ্রহণ করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা উন্নয়ন সংস্থার সাথে (ইউনোস্কোর) একটি সমন্ময় সহযোগিতার কর্মসূচী নেওয়া হয়। ১৭ মার্চ ছিল স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের জন্মদিন। পুরো বাংলাদেশে উৎসব মুখর পরিবেশ ছিল। বিশেষ করে ঢাকা শহরকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে তাঁর কর্মময় জীবনের নানা দিক তুলে ধরে ব্যানার, পোষ্টার, তোরণ ও ছবি দিয়ে। রাজধানী ঢাকা শহর হয়ে উঠেছিল মুজিবময়। সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন ভবনগুলোকে সাজানো হয়েছিল রঙিন আলোকসজ্জায়। এমন সময় পুরো রাজধানীর চিরচেনা রূপই যেন বদলে যায়। ভবনে ভবনে জ্বলজ্বল করছিল বঙ্গবন্ধুর ছবি ও মুজিব শতবর্ষের বিশেষ লোগো। অনেকেই ঘর থেকে বের হয়েছিলেন শহরের দৃষ্টিনন্দন সাজসজ্জা ও আলোর রোশনাই দেখতে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছিল মনোমুগ্ধকর আতশবাজী। চট্টগ্রামে আতশবাজির সঙ্গে ছিল ফানুসের ঝলকও। দেশের বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ছিল ফুলে ফুলে ঢাকা। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ১০০ জন হাফেজের মাধ্যমে ১০০ বার কোরআন খতম করা হয়। মুজিববর্ষ উপলক্ষে বছরব্যাপী বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বৃক্ষরোপণ অন্যতম। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আওতায় সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০০টি করে মোট ৩০০ লাখ বৃক্ষ রোপন করা হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রনালয় আয়োজিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী ঢাকাসহ সারা দেশে দোয়া ও মোনাজাত করেছে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর ত্বত্তাবধানে ১০০বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দিবসের অনুষ্ঠান শুরু হয়। পরবর্তীতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। শোভাযাত্রায় বঙ্গবন্ধুর ছবি আর গুরুত্বপূর্ণ বাণীসংবলিত ব্যানার ও ফেষ্টুন প্রদর্শন করা হয়। সেনাবাহিনী. নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত সব স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কে-৮ ডাব্লিউ ও পিটি-৬ বিমানের সমন্বয়ে প্রদর্শনীতে ফলমেশন ফ্লাইংয়ের মাধ্যমে অনন্য দক্ষতায় ১০০( এক শত) তৈরী করেন। বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধের উপর লাল-সবুজ আবির ছড়িয়ে মনোজ্ঞ প্রদর্শনী করেছে। হেলিকপ্টারগুলোতে জাতীয় পাতাকা এবং মুজিব বর্ষের লোগো খচিত ছিল। ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২৬ মার্চ ২০২১ সাল পর্যন্ত জন্মবার্ষিকী উদযাপনের পাশাপাশি ২০২১ সালে উদযাপিত হবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী সাড়ম্বরে উৎযাপনের প্রস্তুতি থাকলেও নভেল করোনা ভাইরাস বৈশ্বিক মহামারি রূপ নেওয়ায় আয়োজন সীমিত করে আনা হয়। স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীর গৌরবময় উৎসব পালনের দিন আসতে আসতে সকল বাধা দূর হবে আশা রাখি। শুধু বাংলাদেশ নয়, বন্ধুপ্রতিম দেশ, ইউনেসকো, ওআইসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাদের আনন্দের ভাগিদার হবে, সোনালী দিনের সাক্ষ্য হয়ে থাকবে।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ডাঃ ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, হালিশহর, চট্টগ্রাম