ডা. মাহফুজুর রহমানের পরিচয় তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের নিয়ে বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী নামে পলিটিক্যালি মোটিভেটেড একটি গেরিলাযোদ্ধা দল গঠন করা হয়েছিলো। ডা. মাহফুজ বিএলএফ-এর একজন কমান্ডার ছিলেন। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গঠিত ১নং সেক্টরের অনেক কিছুই ছিলো চট্টগ্রামের ছাপমারা। যেমন হরিণায় ক্যাম্প তৈরি করার সময় চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতারা মাস্টারদা সূর্যসেন ও জননেতা এম এ আজিজের নামে নামকরণ করেন। বিএলএফ গ্রুপ গঠন করে দেশে পাঠানোর আগে তাদের নামকরণ করেন আমাদের নদী কর্ণফুলীর নামে। যেমন কেসি-১, কেসি-২ ও কেসি-৩। কেসি মানে কর্ণফুলী কনটিনজেন্ট। ডা. মাহফুজুর রহমান কেসি-৩-এর কমান্ডার ছিলেন। ডা. মাহফুজুর রহমান বিস্ফোরক বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম শহরে প্রায় সব বিস্ফোরণ অপারেশন ডা. মাহফুজুর রহমানের গ্রুপই করে।
মৌলভী সৈয়দ ও ইঞ্জিনিয়ার আফছার উদ্দিনের পর দু’জন মুক্তিযোদ্ধা চট্টগ্রামে বিশেষ সম্মান ও খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। এই দুই মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান ও ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ আল হারুন। অবশ্য কাজী ইনামুল হক দানুও একজন প্রভাবশালী ও সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক ছিলেন। মোনায়েম খানকে জুতা মেরে রূপকথার নায়কের খ্যাতি পাওয়া দানু ভাই বারবার আর্মি, পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অবশ্য হারুন ভাইও কম নির্যাতন ভোগ করেন নি। হালকা পাতলা শরীরে কিভাবে তিনি মিলিটারির অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করলেন আমি বুঝতে পারি না। ‘ফকির’ নামে খ্যাত মাহফুজুর রহমান এতই চালাক যে পুলিশ কখনো তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারে নি। তবে তাঁর ছোট ভাই দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজুর রহমান নির্যাতিত হয়েছেন। তিনি পরে সম্ভবত ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। মাহফুজ ভাইয়ের বড় ভাই মোস্তাফিজ ভাইও ছাত্রনেতা ছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একাত্তরে অর্জিত সুনাম রক্ষা করতে পারা বেশ কঠিন সাধনার কাজ। হারুন ভাই ও মাহফুজ ভাইয়ের নামে কোন দুর্নাম নেই, পদ্ম ফুলের ন্যায় শ্বেত শুভ্র নির্মল তাঁদের জীবন। কোন মালিন্য তাঁদেরকে স্পর্শ করতে পারে নি। দানু ভাইও তাই।
হারুন ভাই নিজেকে গুটিয়ে রাখেন, আপন বিবরে বন্দি করে রাখেন নিজেকে। ফলে তিনি যে আমাদের মধ্যে বর্তমান আছেন, সেটাই বুঝতে মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। খুবই চাপা মানুষ, ন্যায় পরায়ণ, নীতিবান, কড়া ধাতের আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ, এমন মানুষকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। হারুন ভাই ভারত বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং নেতাজী সুভাষ বসুর বিশ্বস্ত সহকর্মী মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর নাতি এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রধান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শাহজাহান ইসলামাবাদীর ভাগ্নে।
তুলনায় মাহফুজ ভাই বেশ প্রকাশিত, খোলা মানুষ। আমার মনে হয় চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর মতো পরিচিতি কারো নেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। মাহফুজ ভাই এমবিবিএস কোর্স কমপ্লিট করে প্যাথলজিক্যাল ল্যাব দিয়ে পেশা জীবনে প্রবেশ করেন। তার আগে কিছুদিন রাজনীতি করেন। ছাত্রলীগের বিভক্তি এবং জাসদ গঠনে তিনি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি চট্টগ্রামে জাসদের একজন শীর্ষ সংগঠক ছিলেন।
কিন্তু মাহফুজ ভাই উদার মনের সহজ সরল মানুষ। এ কারণে সবাই তাঁকে খুব ভালোবাসে। অনেকে তাঁর সরলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে তাঁকে বিপদেও ফেলেছে। যাই হোক, মাহফুজ ভাই তাঁর ভাষায় মানুষের মল-মূত্র ঘেঁটে কিছু পয়সা রোজগার করে পারিবারিক উন্নতি ও সচ্ছলতার প্রতি মনোযোগ দেয়ার পরিবর্তে তিনি কষ্টার্জিত অর্থের অপব্যয়ের অনেক ফ্রন্ট খুললেন। পত্রিকা করলেন, কিন্তু পত্রিকা যে হাতির খোরাক সেটা বুঝলেন না, যখন বুঝলেন তখন জলের মত অনেক টাকা বেরিয়ে গেছে। অনেকে যৌথ ব্যবসার প্রস্তাব নিয়ে আসলেন, তিনি বুঝে না বুঝে আগুনে ঝাঁপ দিলেন। তারপর পুড়ে টুরে কোনমতে বেঁচে ফিরে আসলেন। এরপর মাহফুজ ভাই যে কাজটা করলেন, সেটাই তাঁর আগে করা উচিত ছিলো। তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে সেই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় নিয়োজিত হলেন।
কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের জন্যও যে কাজ ভারি বা বড় বলে বিবেচিত হতে পারে কিন্তু ডা. মাহফুজ সেটাও কাঁধে বহন করে দৌড়াতে পারেন। তিনি নতুন যে কাজটা হাতে নিলেন সেটা আরো ব্যয়বহুল এবং কষ্টকর কাজ। তবে বুকের পাটা বটে ডা. মাহফুজের। চিরকালই দুঃসাহসী মানুষ। কাজের চাপ বেশি হলেও তাঁকে কাবু করা যায় না। বরং বুকের ছাতি কয়েক ইঞ্চি ফুলে ওঠে। এমন মানুষের কাছে টাকা-পয়সা, ভয়ডর, পর্বতপ্রমাণ কাজ সবই তুচ্ছ। ব্যক্তি ডা. মাহফুজের এমন গুণ যে, তিনি কোন কোন সময় সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বড় হয়ে উঠতে পারেন। “বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম” শিরোনামে ১৯৯৩ সালে দেড় সহস্রাধিক পৃষ্ঠার যে ঢাউস বইটি লিখলেন সেটি কি আসলেই একজন ব্যক্তির পক্ষে লেখা সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধ এক মহাকাব্য। সেই মহাকাব্যের বিশালতাকে তিনি দুই মলাটের মধ্যে কিভাবে সংকুলান করলেন, সেটা আমার কাছে এক বিরাট বিস্ময়। কী নেই তাঁর বইয়ে, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি স্বাধীনতা সংগ্রাম; সেই সংগ্রামকে আবার অনেক পেছন থেকে তুলে এনে একাত্তরে মিলিয়েছেন। আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের খুঁটিনাটি বিবরণ পাওয়া যাবে ডা. সাহেবের বইয়ে। মুক্তিযুদ্ধের এমন কোন ঘটনা, এমন কোন অপারেশন তা যত ক্ষুদ্রই মনে হোক না কেন, ডা. সাহেব তাকেও যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তাঁর গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, আশ্রয়দাতা, কুরিয়ার, গাইড, যোদ্ধা-কেউ বাদ পড়ে নি তাঁর দৃষ্টিসীমা থেকে।
মুক্তিযুদ্ধকে এমন সমগ্র্রতার প্রেক্ষাপটে যিনি ধরতে চেষ্টা করেছেন, জাতি না হলেও অন্তত চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে তাঁর অভিনন্দন বা ধন্যবাদ পাওয়া উচিত ছিলো। কোনো জাতীয় পত্রিকায়, চট্টগ্রামের পত্রিকায় এত শ্রমসাধ্য, গবেষণামূলক পুস্তকটিকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোন আলোচনাও চোখে পড়লো না। প্রতি বছর সরকার স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়; কারা পান এই পুরস্কার? কী যোগ্যতা তাদের ? স্বাধীনতা সংগ্রাম বা মুক্তিযুদ্ধের জন্য তাঁদের কী অবদানের জন্য তাদেরকে মহার্ঘ পুরস্কারটি দিয়ে সরকার ধন্য হন। ডা. মাহফুজ আশির দশক থেকে মুক্তিযুদ্ধ চর্চায় নিরন্তর নিয়োজিত আছেন। চট্টগ্রামে অনেক মুক্তিযোদ্ধা, শুধু তিনজন মানুষকেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় লিপ্ত হতে দেখলাম। মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, ডা. মাহফুজুর রহমান ও ইদরিস আলম। ড. শামসুল আলম সাঈদ, কাজী ইনামুল হক দানু, প্রয়াত শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, আমার মামা সিরু বাঙালি, অনুজপ্রতিম সাখাওয়াত হোসেন মজনু, শামসুল হক, জামালুদ্দিন ও নেছার আহমদ-মুক্তিযুদ্ধ চর্চার ইতিবৃত্তে এদের নামও বিবেচনায় আনতে হবে।
রফিক সাহেব হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পিতা; তিনি আমাদের সেক্টর কমান্ডার; সবচেয়ে বড়ো কথা হলো তিনি মুক্তিযুদ্ধের পথিকৃৎ; সমগ্র দেশের মধ্যে তিনিই প্রথম ২৫ মার্চ রাত সাড়ে আটটায় চট্টগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন। তারপর নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ করেন, বিজয় পর্যন্ত প্রায় ৭ মাস সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ১নং সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। স্বাধীনতার পর তিনি চট্টগ্রামে ‘পিপলস ভিউ’ নামে একটি ইংরেজি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে থাকেন। পরে তা ইংরেজিতে Tale of million, ‘বাংলায় লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। তাঁর আগে আর কেউ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। আমি নাও জানতে পারি। সেজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
তবে ডা. মাহফুজের ন্যায় পূর্ণতাপ্রয়াসী বই আর কেউ লেখেননি। তিনি উক্ত বই লেখার জন্য টেকনাফ থেকে শুভপুর এলাকায় যত মুক্তিযোদ্ধা আছে, প্রায় সবাইকে দাওয়াত করে শহরে এনে তাদের বক্তব্য টেপে ধারণ করেছেন, তারপর টেপ থেকে লিখে তাঁর বইয়ে পরিবেশন করেন। তবে যাচাই বাছাই করে। নিজে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বলেই তাঁর পক্ষে অন্তত হাজার খানেক মুক্তিযোদ্ধাকে এক জায়গায় জড়ো করা সম্ভব হয়েছিলো। গরু জবাই করে তাদেরকে মেজবানী খাইয়েছেন। রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাবে এই সমাবেশ হয়েছিলো। পরে এরকম আরো দু’তিনটি সমাবেশ করে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের বিচরণ, অভিজ্ঞতা রেকর্ড করেছেন। পুরোনো প্রেসক্লাবে আরেকটা সমাবেশ হয়েছিলো আমার মনে পড়ছে।
তৃণমূল পর্যায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা, যুদ্ধের বিবরণ সংগ্রহ করায় ডা. সাহেবের বই-মুক্তিযুদ্ধের একটি বিশ্বস্ত দলিল হিসেবে গবেষক ও সুধীমহলে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী ইতিহাস প্রণয়নের জন্য তিনি চট্টগ্রামের তৎকালীন একমাত্র পত্রিকা দৈনিক আজাদীর ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পুরোনো ফাইল ঘেঁটে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। জাতীয় ইতিহাসের জন্য জাতীয় পত্রিকার পুরোনো ফাইল থেকে সন তারিখসহ ঘটনাবলী সংকলন করেছেন। একারণে ডা. সাহেবের গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের আকর গ্রন্থ হিসেবে সর্বমহলে সমাদৃত হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর যত ইতিহাস লিখিত হচ্ছে, তাতে চট্টগ্রামের ঘটনার বিবরণ সংগ্রহের জন্য সবাই ডা. সাহেবের বই ব্যবহার করছেন। বিশালায়তনের প্রথম পুস্তকটি ছাড়াও ডা. সাহেব ইতিমধ্যে আরো বহু বই লিখে ফেলেছেন। সবই মুক্তিযুদ্ধের বই। সেজন্য আমার বিবেচনায় ডা. মাহফুজুর রহমানের স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া উচিত। তাঁর মতো করে মুক্তিযুদ্ধের ওপর গবেষণা কেউ করছেন বলে মনে হয় না।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক সংগঠক