শিম্পাঞ্জি মানুষেরই প্রতিচ্ছবি

ইসমত আরা জুলী | সোমবার , ১৫ মার্চ, ২০২১ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

প্রাণীজগতে মানুষের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়টির নাম শিম্পাঞ্জি। মানুষের ডিএনএ ৯৮.৬% মিলে এই নিকটাত্মীয়ের সাথে। এই সংখ্যা বানর, বড় উল্লুক বা অন্য যেকোন প্রাণীর ডিএনএ এর সাথে যে মিল রয়েছে তার চেয়ে বেশি। শারীরিক গঠন, আবেগ ও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে মানুষের সাথে এর সাদৃশ্য চোখে পড়ার মত। এই প্রাণীকে কাতুকুতু দিলে তারা আমাদের মতই হাসিতে লুটিয়ে পড়ে। জীবনের প্রথম পাঁচ বছর এরা খেলাধুলায় ও সামাজিকতায় মত্ত থাকে। এই সময়ে মায়ের সঙ্গে শিশু সন্তানের একটি সুদৃঢ় বন্ধন প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও মানব-মস্তিষ্ক এদের মস্তিষ্ক থেকে আকারে বড় কিন্তু গঠনগতভাবে দুটির মিল বেশ লক্ষণীয়। শিম্পাঞ্জিরা চিন্তা ভাবনাকে যৌক্তিক করে তুলতে পারে ও সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রাণীজগতের অধিকাংশ প্রাণী আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব চিনতে পারে না কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে এরা তা পারে। শিম্পাঞ্জির দেহকাঠামো ঠিক মানুষের মত। আমাদের হাড়, মাংসপেশী ও স্নায়ুতন্ত্র একইরকম এবং হাত ও পায়ে সমানসংখ্যক আঙুল রয়েছে। আমরা যেভাবে জগতকে দেখি ও তার থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করি এরাও ঠিক তাই করে। তাদের দর্শন, ঘ্রাণ, শ্রবণ ও স্পর্শের ইন্দ্রিয়ানুভূতি একেবারেই মানুষের মত। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এসব প্রমাণিত হয়েছে। ডক্টর জেইন গুডঅলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হচ্ছে এই যে, শিম্পাঞ্জি খাবার খাওয়ার জন্য, পানি পান করার জন্য ও নিজেদের পরিষ্কার রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের টুলস যেমন, গাছের কান্ড, শাখা, পাতা ও পাথর ব্যবহার করে। এরা দূরের জিনিসকে কাছে টেনে আনার পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত আর অস্ত্র হিসেবে বড় বড় পাথর ছুঁড়ে মারার কাজও তারা করে থাকে।
শৈশবেই আমরা ভাগাভাগি করার শিক্ষা পেয়ে থাকি। এটা অনেকে হয়ত জানে না যে শিম্পাঞ্জিরাও তাদের খাবার ও টুলস ভাগাভাগি করে থাকে। জেইন গুডঅলের অন্যতম একটি আবিষ্কার হচ্ছে এই যে, এরা মানুষের মত দলবদ্ধভাবে মাংস শিকারের জন্য বেরিয়ে পড়ে। তাদের আছে নিজস্ব শারীরিক ভাষা যা মানুষের মতই। তারা পরস্পরকে চুমু খায়, জড়িয়ে ধরে, একজন আরেকজনের পিঠ চাপড়ে দেয়, হাত ধরে থাকে ও করমর্দন করে। এরা শুধুমাত্র পারস্পরিক যোগাযোগে অভ্যস্ত তা নয়, এরা আনন্দ, দুঃখ, ভয় ও সহানুভূতির মত মানবিক আবেগগুলো প্রকাশ করতে পারে।
এই দুই প্রাইমেটসের এত মিলের মধ্যে কিছু কিছু অমিলও চোখে পড়ে। মানুষ দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার মস্তিষ্ক বড় আকারের ও তার শরীরের লোমশ অংশ একেবারেই কম – এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের এই নিকটাত্মীয়টির নেই। প্রাণীজগতের এই আমোদপ্রিয় ও বুদ্ধিমান আত্মীয়টিকে নিয়ে যত বেশি গবেষণা হবে তত বেশি মানুষের সাথে অমিলের চেয়ে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। মানুষের মত তাদেরও নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও ভালবাসার প্রয়োজন।
শিম্পাঞ্জিদের আচরণ ও চিন্তাভাবনা সম্পর্কিত গবেষণায় আরও উঠে এসেছে যে এরা শুধু আমাদের মত জোরে জোরে হাসে না, মুচকি হাসি দেবার ক্ষমতাও এদের রয়েছে। এরা খেতে ভীষণ ভালবাসে, নিয়মিত খেলাধূলা করে, সুনির্দিষ্টভাবে চিন্তাভাবনা করতে পারে, ভালো ও মন্দের পার্থক্য অনুধাবন করতে সক্ষম এবং বন্ধুত্ব স্থাপন করতে সমর্থ।
ঘন্টার পর ঘণ্টা তারা যে দলবদ্ধ হয়ে খেলাধুলা করে, এর ফলাফল হিসেবে তাদের মধ্যে সুদৃঢ় সামাজিক বন্ধন গড়ে উঠে ও অন্যকে সহযোগিতা করার মনোভাব বৃদ্ধি পায়। মানুষের মত বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের খেলার সাথীরও পরিবর্তন হয়। শৈশবে প্রীতিময় খেলাধূলা বড় হবার পর অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠে।
এরা যে জোরে জোরে হাসতে পারে আবার মুচকি হাসিও দিতে পারে, এই সুস্পষ্ট আবেগগুলো আগে মনে করা হত শুধুমাত্র মানুষেরই বৈশিষ্ট্য। এ সংক্রান্ত সব গবেষণায় দেখা গেছে যে, হাসির সাথে সম্পর্কিত মুখায়বের অভিব্যক্তি আমাদের প্রাইমেট পূর্বপুরুষদের ছিল যা মানব বিবর্তনের বহু আগেই দেখা গেছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায় যে, যদিও শিম্পান্‌িজরা তাদের পছন্দের খাবার কিনতে কোন সুপারমার্কেট বা রেস্তোরাঁয় যেতে পারে না কিন্তু তারা নিজেদের পছন্দের খাবারের খোঁজে অনেকদূর পর্যন্ত ভ্রমণ করে। তারা মানুষের মত কাঁচা খাবারের চেয়ে রান্না করা খাবার বেশি পছন্দ করে। রান্না করার সময় খাবারের যে পরিবর্তন হয় তা বুঝতে তাদের বেগ পেতে হয় না। শিম্পাঞ্জিকে যদি একটি কাঁচা আলু ও একটি রান্না করা আলু দেওয়া হয় তবে নির্দ্বিধায় সে পরেরটিই বেছে নেবে। রান্নাঘরের যে কাজটি করতে তারা অসমর্থ তা হচ্ছে চুলার আগুন নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু তাদেরকে যদি একটি উত্তপ্ত কড়াই দেওয়া হয় তবে সেটা কীভাবে ব্যবহার করবে তা তাদের বুঝতে বেশি সময় লাগে না।
এরা নিজেদের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে ভীষণ সচেতন। কোনটা সে জানে এবং কোনটা সে জানে না তা সহজেই বুঝাতে পারে। গভীর আত্মবিশ্বাস ও কম আত্মবিশ্বাসের কারণে তাদের মধ্যে যে আচরণ ও প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তা থেকেই এটা বোঝা যায়। এর ফলে তারা বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ভাল ও মন্দের পার্থক্য করার ক্ষমতা শুধু মানবকূলের নয়, শিম্পাঞ্জির মত প্রাণীরও রয়েছে আর তাই সে তার সঠিক আচরণ সম্পর্কে অবগত। তার কোন আচরণে শিশুসন্তান প্রভাবিত হবে সে ব্যাপারেও সে সজাগ। জুরিখ ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, যদি কোন শিম্পাঞ্জি শিশু তার নিজের গোত্রের অন্য কারও দ্বারা আক্রান্ত বা নিহত হয় তখন সে রাগে ও ক্রোধে অন্ধ হয়ে যায় যা পূর্ণবয়স্ক বানরের মধ্যে দেখা যায় না। এই গবেষণা এটাই প্রমাণ করে যে এই প্রাইমেট মানুষের মত ন্যায় – অন্যায় সম্পর্কে সচেতন।
শিশু শিম্পাঞ্জির পর্দায় দেখানো সংখ্যা মনে রাখার ক্ষমতা পূর্ণবয়স্ক মানুষের মনে রাখার ক্ষমতাকে হার মানায়। বিজ্ঞানীরা এটাকে ফটোগ্রাফিক মেমরি বলে অভিহিত করেছেন। পৃথিবীর প্রাণীজগতের মধ্যে শুধুমাত্র মানুষ ও শিম্পাঞ্জি সংঘবদ্ধভাবে শত্রুর উপর আক্রমণ চালাতে পারে।
“যার বন্ধু আছে তার বিশাল সম্পদ আছে” – এই প্রবাদটি এদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ফিলিপ্পো আরেলি শিম্পাঞ্জিদের আচরণের উপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, এই প্রাইমেটসরা বন্ধু-বান্ধব পরিবেষ্টিত থাকতে ভালবাসে। তারা বিপদের সময় পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করে ও খাদ্যদ্রব্য ভাগাভাগি করে খায়। তারা একে অন্যকে আরাম ও স্বস্তি দিয়ে থাকে যাতে তাদের মানসিক চাপ দূরীভূত হয়। বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তারা বাছাবাছি করে ; যারা তাদের ব্যাক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তাদের দিকেই শুধু বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়।
আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী, মানুষ ও শিম্পাঞ্জির ডিএনএ ৯৮.৮% পর্যন্ত একইরকম। বিশ্বাস না হলেও এটি সত্য যে মানুষ ও শিম্পাঞ্জির উৎপত্তি একই প্রজাতি থেকে, যদিও শিম্পাঞ্জির অস্তিত্ব ৭০ লাখ বছর আগেও ছিল বলে জানা যায়। এ কারণেই এই দুই প্রাইমেটস এর শারীরিক ও মানসিক সাদৃশ্য তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। তবে অন্যসব প্রাণীর মতই এরা কথা বলতে পারে না কারণ তাদের স্বরতন্ত্রী গলা থেকে উপরে অবস্থিত যা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। মানুষের রয়েছে একটি “ল্যাংগুয়েজ অর্গান” যা অন্য প্রজাতির নেই। তবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলে এরা সাংকেতিক ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠতে পারে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি শোভন, সুন্দর ও আনন্দের খবর
পরবর্তী নিবন্ধসাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি