আমাদের দেশ ও সমকালীন বিশ্ব এক নজিরবিহীন আর্থ-রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। প্রাণ ও প্রকৃতির উপর প্রচলিত পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার যথেচ্ছাচার তৈরি করেছে সাম্প্রতিক সময়ের বিধ্বংসী বৈশ্বিক মহামারি। সামাজিক ও স্বাস্থ্য পরিষেবা যে সব দেশে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সে রকম কয়েকটি মুষ্টিমেয় দেশ ছাড়া এই মহামারি উন্নত-অনুন্নত সব দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার দুর্বলতা তথা প্রচলিত বিশ্ব ব্যবস্থার গভীর সংকট স্পষ্ট করে তুলেছে মানবজাতির কাছে। এই ব্যবস্থার সর্বব্যাপী সংকট এই সত্যকে প্রতিভাত করেছে যে মানব সভ্যতা পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থার উদগ্র মুনাফার লোভের কাছে নিরাপদ নয়। এমনকি বহুচর্চিত, বহুকীর্তিত শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর কথিত উদার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাও আজ চরম সংকটের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রে, যুক্তরাজ্যে মুনাফালোভী ব্যক্তি মালিকানাধীন বিশাল বিশাল কর্পোরেট হাউসগুলোর স্বার্থের বিশ্বস্ত পাহারাদার দ্বি-দলীয় একটি নির্বাচনি ব্যবস্থা গণতন্ত্রের নামে দুই শতাধিক বছর ধরে চালু আছে, যা ভাবাদর্শগত দিক থেকে এক দলীয় শাসনের নামান্তর। তৃতীয় কোনো শক্তি শত বছরেও এসব দেশের ক্ষমতার চৌহদ্দির মধ্যে আসতে না পারার কৌশলী ব্যবস্থা করে রাখা আছে। যুক্তরাষ্ট্রে হয় ডেমোক্র্যাট নয়তো রিপাবলিকান, যুক্তরাজ্যে হয় কনজারভেটিভ নয়তো লেবার পার্টি পালাক্রমে শাসন করে চলেছে। কিন্তু এই সাজানো ব্যবস্থাও আজ উন্নত পুঁজিবাদ সহ্য করতে পারছে না। সম্প্রতি প্রায় সমমনা ও সমআদর্শের দুই দলের মধ্যে নির্বাচনি লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে গেল। এটা শুধু ব্যক্তি ট্রাম্পের অপ্রকৃতিস্থতা বলে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার অবকাশ নেই। উপমহাদেশে উগ্র ধর্মান্ধতার মতো আমেরিকাতেও বর্ণবাদী উগ্র শ্বেতাঙ্গ ফ্যাসিস্ট শক্তি ট্রাম্পের নেতৃত্বে আমেরিকাকে বিভক্ত করে ফেলেছে। এই সহিংস ডানপন্থাই হলো বিশ্ব পুঁজিবাদের নিশ্চিত ভবিতব্য। কিন্তু সপ্তদশ শতকে পুঁজিবাদের প্রাথমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান ও শিল্পবিপ্লব হাত ধরাধরি করে চলেছে। সামন্ততন্ত্রের দুঃশাসন ও আমানবিক ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে পুঁজিবাদ প্রগতিশীলতার পথ ধরেছিল। ধর্মনিরপেক্ষ ইহজাগতিক রাষ্ট্র্রব্যবস্থার যে শক্ত অবস্থান আজ ইউরোপ-আমেরিকাতে দেখি তা তো পুঁজিবাদের অবদান। সেই রেঁনেসা পরবর্তী সময়ে গড়ে উঠা পুঁজিবাদী শাসনের সামাজিক মূল্যবোধগুলোকে আমরা এখনো আধুনিক সভ্যতার স্মারক চিহ্ন বলে মনে করে থাকি। কিন্তু সেই ব্যবস্থার আপাত ভদ্র কাঠামো ক্রমে মুনাফার লোভ ও সংঘাতে ভেঙে পড়তে থাকে এবং বর্তমানে তা চূড়ান্তভাবে দুর্বৃত্তায়িত হয়ে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান ক্ষুধা, বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী বিভেদসহ বিশ্বব্যাপী সব ধরনের নেতিবাচক নৈতিক অধোগতি ও সামাজিক ও বৈশ্বিক সংকটের জন্য আজ এই মুনাফালোভী বিশ্বব্যবস্থাই দায়ী। একেই আমরা সাধারণত ডানপন্থা বা দক্ষিণ পন্থী রাজনৈতিক অর্থনীতি বলে থাকি। উগ্র ডানপন্থী ট্রাম্প, মোদী, পুতিন, এরগোদানদের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে আজ কলুষিত হয়ে উঠেছে পৃথিবীর বাতাস। বিষফোড়ার মতো যুক্ত হয়েছে সামষ্টিক কল্যাণের নামে শি চিন ফিংদের মতো অবিবেচক কর্তৃত্ববাদীদের শাসন, অগণতান্ত্রিক জবরদস্তি ও ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা। অদ্ভুত এক আঁধার নেমেছে পৃথিবীতে আজ।
প্রশ্ন উঠতে পারে মানব মুক্তি কোন্ পথে? একটি কল্যাণকামী সাম্যবাদী নিরাপদ মানবিক সমাজের স্বপ্ন মানুষ সহজাত শ্রেয়োবোধ থেকে যুগ যুগ ধরে দেখেছে। অষ্টাদশ শতকে রবার্ট ওয়েন, চালর্স ফুরিয়ের, সেন্ট সাইমন প্রমুখ নিজেদের মতো করে সমাজতন্ত্রের বা শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এঙ্গেলস তাঁদের ইউটোপিয়ান সোশ্যালিস্ট বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী বলে বর্ণনা করেছিলেন। পরবর্তীতে কাল মার্কস ব্রিটিশ ক্যাপিটেলিজমকে বিশ্লেষণ করে, মানব সভ্যতার বিকাশের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যা করে বৈজ্ঞানিকভাবে দেখাতে চাইলেন উৎপাদন উপায়ের ব্যক্তি মালিকানার স্থলে সামাজিক মালিকানা ও সুষম গণবণ্টন ভিত্তিক কল্যাণকামী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাই মানব জাতির অনিবার্য ভবিতব্য ও মুক্তির পথ। লেনিনের নেতৃত্বে সংঘটিত ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে এই ভাবনার মূর্ত প্রকাশ ঘটে। ক্রমে গড়ে উঠে একটি সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা। উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদনের উপায়ের সামাজিক মালিকানা ভিত্তিক এই ব্যবস্থাকে আমরা সচরাচর বামপন্থা বলে বুঝি।
প্রবল শক্তিধর বিশ্বপুঁজিবাদের অবরোধ, বেষ্টনী ও সরাসরি আক্রমণের মুখে এক ধরনের লৌহ যবনিকার অন্তরালে পূর্ব অভিজ্ঞতা বিহীন পশ্চাদপদ একটি দেশে বামপন্থার বাস্তব পরীক্ষা হিসেবে কল্যাণমূলক সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়তে গিয়ে লেনিনের মৃত্যুর পরে অসহিষ্ণু উগ্র নেতাদের হাতে গড়ে উঠা কর্তৃত্ববাদ, পার্টি আমলাতন্ত্র, প্রায়োগিক ভুল, জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি ইত্যাদি কারণে বিশ্বকে তাক লাগানো সামষ্টিক কল্যাণে আসাধারণ অগ্রগতি সাধন করে, বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনে, মননে স্থায়ী মৌলিক কিছু সদর্থক পরিবর্তন সাধন করে, সে ব্যবস্থাটি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। কিন্তু তাতে মানবমুক্তির বিশ্বজনীন চিরায়ত আবেদন তো মিথ্যা হতে পারে না বরং প্রচলিত বিশ্বব্যবস্থা সার্বিক সংকটের কারণে তা আরো উচ্চকিত হয়েছে। বিশ্ব পুঁজির আগ্রাসী হুমকির মুখেও ভেনেজুয়েলা থেকে ভিয়েতনাম পর্যন্ত নব নব বৈচিত্র্য ও রূপ নিয়ে বাম আন্দোলন বিকশিত হচ্ছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে বার্নি স্যান্ডার্স ও যুক্তরাজ্যে জেমস করবিন অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সামাজিক মালিকানার পক্ষে কর্পোরেট হাউসের অতিমুনাফার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বিশ্বব্যাপী চলমান তীব্র আর্থ-রাজনৈতিক সংকট ও ডানপন্থার ব্যর্থতা বিকল্প হিসাবে বামপন্থাকে অপরিহার্য করে তুলেছে নানা দেশে নানা মাত্রায়। বর্তমানে মানব মুক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্যে কোন সুনির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক মডেলের অনুপস্থিতিতে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেশে দেশে সৃজনশীল নৈপুণ্যে, মানবিক বিবেচনায় ও বাস্তব জাতীয় বৈচিত্র্যে বিকশিত হবে বামপন্থা- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাব্য আনুকূল্যে। কিন্তু প্রচলিত ডানপন্থি ব্যবস্থা মানব মুক্তির বিকল্প কিছুতেই হতে পারে না।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কোন বামদল ক্ষমতায় যায়নি বা বামপন্থার কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং বিশ্ব পুঁজিবাদের চাপে বিভিন্ন দেশ ১৯৮০’র দশক থেকে লুটেরা নিওলিবারেল বাজার অর্থনীতির পথে চলতে থাকে যার অনিবার্য রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ভারতে, বাংলাদেশে উগ্র ধর্মান্ধতা প্রবলভাবে বিকশিত করে জনগণকে ধর্মের নামে বিভক্ত ও মোহাচ্ছন্ন করে ফেলেছে। মূলত ১৯৭৫ সালের পর থেকে আমাদের দেশে সামরিক শাসনের অধীনে ডান পন্থা তথা মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্টের নামে বিশ্ব ব্যাংক-এর নির্দেশে সরকারি কলকারখানা, ব্যাংক-বীমা পানির দামে বিক্রি করে দিয়ে, ব্যাংকের টাকা ইচ্ছামতো ঋণের নামে লোপাট করে রাতারাতি এ দেশে কিছু লুটেরা কর্পোরেট হাউস গড়ে তোলা হয়। ক্রমে বিপুল শক্তির অধিকারী হয়ে ঐ কর্পোরেট হাউসের দুর্বৃত্ত মালিকরা এখন দেশের প্রকৃত শাসকশ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। বিগত প্রায় ৪৫ বছর ধরে সেই ডানপন্থী ধর্মাশ্রয়ী দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক অর্থনীতির ধারায় দেশ চলেছে গড়ে উঠেছে এক বিকৃত সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ, আত্মপর লুটেরা ও সাম্প্রদায়িক সামাজিক মনস্তত্ত্ব। সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগ ’৯০ এর দশক থেকে ক্ষমতার সমীকরণে ক্রমে ডানে চলতে থাকে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খুনিদের তথা সামরিক শাসকদের আর্থ-রাজনৈতিক দর্শন তথা লুটেরা ব্যক্তি মালিকানাধীন নীতি আদর্শ গ্রহণ করে এবং ক্ষমতায় এসে সেই ধারায় দেশ চালাচ্ছে। ১৯৯১ সাল থেকে দুই বৃহৎ দল দুই বিপরীত রাজনৈতিক অবস্থানে থেকেও একই লুটেরা অর্থনৈতিক নীতি আদর্শ অনুসরণ করে চলেছে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে গণতান্ত্রিক অসহিষ্ণুতা থেকে একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে কষ্টার্জিত ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রকেই ধ্বংস করে দিয়ে এক ভয়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। লুটেরা অপরাজনীতির প্রভাবে দেশে বর্তমানে বিরাজ করছে এক রাজনৈতিক শূন্যতা। দুর্বল হয়ে পড়া বামদলগুলো সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারছে না। ফলে ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদ বিপজ্জনকভাবে শক্তি সঞ্চার করে এগিয়ে আসছে। গণতন্ত্রহীনতা ও জবাবদিহিতার অভাবে গ্রামে-গঞ্জে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতি, জবরদস্তি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, সাম্প্রদায়িকতা। লুটেরা দুর্বৃত্তায়নকে নিরাপদ রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠীর ইন্ধনে ধর্মের নামে সমাজে চলছে চরম বিদ্বেষ, বিভক্তি। ইহজাগতিক নিপীড়নকে আড়াল করার জন্য প্রতিনিয়ত পারলৌকিকতার ভয় দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে ভারতে, বাংলাদেশে সর্বত্র। চলমান যে-কোনো সামাজিক অপকর্ম, অপরাধ কোন বিচ্ছিন্ন বিষয় নয় তা প্রকারান্তরে দীর্ঘ দিনের অনুসৃত এই ডানপন্থি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের আবর্জনা মাত্র। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে অনুসৃত ডান রাজনীতির চরম ব্যর্থতা বাংলাদেশে বিকল্প হিসেবে বামপন্থার প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতাকে জীবন্ত করে তুলে। বিদ্যমান বামদলগুলো দিয়ে শুধু নয় ’৭২ এর সংবিধান অবিকৃতভাবে বাস্তবায়নে কঠিন কর্মসূচি সামনে রেখে ’৭১ এর প্রকৃত চেতনায় ঋদ্ধ কল্যাণকামী, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সব ব্যক্তি, পেশাজীবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তির অভিজ্ঞতা, অবিরাম পথচলা ও সংগ্রামের মিথষ্ক্রিয়ায় গড়ে উঠতে পারে বামমুখী প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের রাজনৈতিক শক্তি ও সংস্কৃতির অনন্য গণজাগরণ।
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট