মি’রাজ রজনীতে নামায ফরজ হলো: মি’রাজের বিস্ময়কর সফরে নবীকরিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক যাত্রাপথে অসংখ্য ঘটনাবলী অবলোকন, মসজিদুল হারাম থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস গমন, সেখানে থেকে আসমানী জগতে পরিভ্রমন, সিদরাতুল মুনতাহা গমন, জান্নাত জাহান্নাম পরিদর্শন, আরশে মুআল্লায় দীদারে এলাহী অর্জন, হাবীব ও মাহবুবের কথোপকথন, সালামের হাদিয়া বিনিময় ও মি’রাজের শ্রেষ্ঠ উপহার পঞ্জেগানা নামায নিয়ে পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন। সামগ্রিক বিষয়াদি অসংখ্য আয়াতে করীমা ও সহীহ হাদীস সমূহ দ্বারা প্রমাণিত।
নবীর ওসীলায় পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায পাঁচ ওয়াক্ত হলো: আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় নবী ইমামুল আম্বিয়া সৈয়্যদুল মুরসালীন রাহমাতুল্লীল আলামীনকে মি’রাজ রজনীতে বহুবিধ নি’য়ামত উপহার ও পুরস্কার প্রদান করে অনন্য অসাধারণ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বে ভূষিত করেন, তন্মধ্যে সর্বাধিক শ্রেষ্ঠ উপহার হলো পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা। মহান প্রভূর শ্রেষ্ঠ নিয়া’মত প্রাপ্ত হয়ে নবীজি উর্ধ্বলোক থেকে আসমানের দিকে প্রত্যাবর্তন কালে হযরত মুসা কলিমুল্লাহ (আ:)’র সাক্ষাৎ হয়। হযরত মুসা (আ:)’র জিজ্ঞাসার জবাবে নবীজি বললেন, দিবারাত্রি পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায আদায় করতে আদিষ্ট হয়েছি। মুসা (আ:) বললেন আপনার উম্মত দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায আদায়ে সক্ষম হবে না। আল্লাহর শপথ, আপনার পূর্বে বনী ইসরাইলের লোকদের থেকে এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি বনী ইসরাইলকে অনেক চেষ্ঠা করেছি। আপনি আপনার প্রভূর নিকট পুনরায় গমন করুন। আপনার উম্মতের জন্য নামায সহজতর করার আবেদন করুন। নবীজি ফিরে গেলেন এবং এ সংখ্যা হ্রাস করার জন্য প্রভূর সমীপে আরজি পেশ করেন, আল্লাহ পাক পাঁচ ওয়াক্ত হ্রাস করলেন নবীজি বললেন হে মুসা, আল্লাহ পাক অনুগ্রহ করে পাঁচ ওয়াক্ত হ্রাস করে দিলেন। মুসা (আ:) পূনরায় বললেন, আপনার উম্মতরা খুবই দুর্বল পুনরায় আপনার প্রভূর দরবারে গমন করুন, এ সংখ্যা কমানোর আবেদন করুন। হযরত মুসা (আ:) নয়বার নবীজিকে নামাযের সংখ্যা হ্রাস করানোর আবেদন করার পরামর্শ দিলেন, এভাবে সরকারে দু আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নয়বার মহান প্রভূর দরবারে আবেদন করেন, আল্লাহ তা’আলা প্রিয় নবীর উম্মতের পঁয়তাল্লিশ ওয়াক্ত নামায হ্রাস করলেন। নবীজি এরশাদ করেন, অদৃশ্য হতে আওয়াজ এলো, পঞ্চাশ ওয়াক্ত ফরজ হিসেবে রয়ে গেল অর্থাৎ এ পাঁচ ওয়াক্ত পঞ্চাশ ওয়াক্তের সমান। যে পাঁচ ওয়াক্ত আদায় করবে সে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াব পাবে। (ইবনে মাযাহ শরীফ, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড ২, পৃ: ৪৭৩)
ইসলামী আক্বিদা: হযরত মুসা (আ:) ইনতিকাল করেছেন, তিনি কবর জগতের বাসিন্দা। নামায ফরজ হয়েছিল পঞ্চাশ ওয়াক্ত, তাঁরই পরামর্শ ও সাহায্যে পয়তাল্লিশ ওয়াক্ত কমিয়ে আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবীবের আবেদনের প্রেক্ষিতে পাঁচ ওয়াক্তে চুড়ান্ত করলেন। প্রমাণিত হলো কবরবাসী রওজা শরীফে শায়িত নবী রাসূলগণ আল্লাহর বান্দাদের কল্যাণ সাধনে পূর্ণমাত্রায় সক্ষম। নবী রাসূল সাহাবায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়ে কেরামের ওসীলা গ্রহণ করাকে শির্ক ও বিদয়াত উক্তিকারীদের উচিৎ পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায আদায় করা, যেহেতু পাঁচ ওয়াক্ত তো হযরত মুসা (আ:)’র সুপারিশ ও ওসীলায় হ্রাস করা হয়েছে। দ্বিতীয় কথা হলো মুসা (আ:) যদি উম্মতের কষ্ট লাগবে সাহায্য করতে সক্ষম হন যিনি সমগ্র নবীকূলের সরদার ইমামুল আম্বিয়া আমাদের প্রিয় নবী দোজাহানের সরদার মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খোদা প্রদত্ত ক্ষমতার বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা কত অপরিসীম তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড ২, পৃ: ৪৭৪)
মি’রাজ যাত্রাপথে প্রত্যক্ষ ঘটনাবলী: হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “আমি মুসা (আ:)’র কবর পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে তাঁকে কবরে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে দেখেছি।” (মুসলিম শরীফ, খন্ড ২, পৃ: ২৬৮, মদারেজুন নবুওয়াত, খন্ড ১, পৃ: ২৯৫)
হযরত মুসা (আ:) নবীজিকে দেখে বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল। (মদারেজুন নবুওয়াত, খন্ড ১, পৃ: ২৯৫)
নামায পড়ার জন্য জীবিত থাকা শর্ত। প্রমাণিত হল হযরত মুসা (আ:) ইন্তেকালের পরও স্বীয় কবরে জীবিত। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা নবীদের দেহসমূহ ভক্ষণ করা ভূপৃষ্ঠের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন। আল্লাহর নবীগন জীবিত ও রিযক প্রাপ্ত। (সুনানে ইবনে মাযাহ, খন্ড ১, পৃ: ৫২৪, হাদীস নং ১৬৩৭, মুদারেজুন নবুওয়াত, খন্ড ১ম, পৃ: ২৯৫, তাবরানী)
বেনামাযীর শাস্তি অবলোকন: মি’রাজ রজনীতে এমন এক সম্প্রদায়ের সাথে নবীজির সাক্ষাৎ হলো যাদের মস্তক পাথর দ্বারা আঘাত করে চুরমার করে দেয়া হচ্ছে, তা পুনরায় পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসছে, শাস্তির এ অবস্থা অব্যাহত ভাবে চলছে। এ অবস্থা দেখে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত জিবরীল (আ:) কে জিজ্ঞেস করলেন এরা কারা? জিবরীল বললেন, এরা সেসব লোক যারা নামায পড়েনা। (মাওয়াহেবে লুদুনীয়া, খন্ড ২, পৃ: ১৫, মুদারেজুন নবুওয়াত, খন্ড ১, পৃ: ২৯৮)
সিদরাতুল মুনতাহায় গমন: নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরাসরি আল্লাহর দিদার লাভে ধন্য হয়েছেন স্বীয় কপালের চোখে মহান প্রভুকে দেখেছেন। এরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয় তিনি (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে আরেকবার দেখেছিলেন। (সূরা: নাজম, আয়াত: ১৩-১৪)
আয়াতের তাফসীরে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় প্রভূকে প্রত্যক্ষ করেছেন। (ইমাম মুহিউদ্দিন ইয়াহইয়া আন-নববী, শরহে মুসলিম, পৃ: ৯৮)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি সিদরাতুল মুনতাহা প্রত্যক্ষ করেছি, এটি একটি বরই বৃক্ষ যার পাতাগুলো হাতির কানের মত, ফলগুলো মটকার মত, (মুসলিম শরীফ, খন্ড ১ম, পৃ: ৯১)
সিদরাতুল মুনতাহা দেখার পর আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হলো। সিদরাতুল মুনতাহার পাশে রয়েছে বায়তুল মামুর, নবীজি বায়তুল মামুরে গমন করলেন সেখানে সত্তর হাজার ফিরিস্তারা নবীজিকে অভ্যর্থনা জানালেন, বায়তুল মামুর হলো ফিরিস্তাদের “কাবা” নবীজি সেখানে ফিরিস্তাদেরকে নামায পড়ালেন, বায়তুল মুকাদ্দাসে আম্বিয়ায়ে কেরামের ইমাম হলেন, আসমানী জগতে ফিরিস্তাদের ইমাম হলেন। (রুহুল বয়ান, খন্ড ৫, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড ২, পৃ: ৪২৯)
যেভাবে মানব জাতি খানায়ে কা’বার তাওয়াফ করে থাকেন, তদ্রুপ বায়তুল মামুর এ দৈনিক সত্তর হাজার ফিরিস্তারা যিয়ারত ও তাওয়াফ করেন। (মুদারেজুন নবুওয়ত, খন্ড ১, পৃ: ৩০১)
দৈনিক সকাল সত্তর হাজার, সন্ধ্যায় সত্তর হাজার ফিরিস্তারা মদীনা মনোওয়ারায় নবীজির রওজা শরীফে যিয়ারতের জন্য উপস্থিত হন ও দরুদ সালামের নজরানা পেশ করেন। (মিশকাত শরীফ, পৃ: ৫৪৬)
কুরআন ও হাদীসের আলোকে নামায: অসংখ্য আয়াতে করীমা ও হাদীসে রসূলে নামাযের গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং নামায বর্জনকারীর জন্য কঠোর শাস্তির সতর্কবাণী বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “নামায কায়েম করো, নিশ্চয় নির্ধারিত সময়ে নামায কায়েম করা মু’মিনদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।” (আল কুরআন, সূরা: নিসা, আয়াত: ১০৩)
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার নিকট নামাযের হিসাব গ্রহণ করা হবে। (নাসাঈ শরীফ, পৃ: ৫৫)
নবীজি আরো এরশাদ করেন, “নামায দ্বীনের স্তম্ভ, যে নামায পরিত্যাগ করল সে দ্বীনের বুনিয়াদ ধ্বংস করল, যে নামায কায়েম করল সে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করলো।” (মুনীয়াতুল মুসাল্লী, পৃ: ৪)
হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে, “প্রতিটি বস্তুর একটি নিদর্শন রয়েছে, ঈমানের নিদর্শন হলো নামায।” (মুনীয়াতুল মুসাল্লী)
নামায জান্নাত থেকে উত্তম: হযরত মুহাম্মদ ইবনে সীরিন (রা.) এরশাদ করেন, আমাকে যদি জান্নাত ও দু’রাকাত নামায দু’টির একটি গ্রহণের এখতিয়ার দেয়া হয়। আমি দু’রাকাত নামাযই গ্রহণ করবো, যেহেতু দু’রাকাত নামাযে রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি, আর জান্নাতে রয়েছে আমার সন্তুষ্টি। (মুকাশিফাতুল কুলুব, আনওয়ারুল বয়ান, খন্ড ২, পৃ: ৪৯১)
হে আল্লাহ আমাদেরকে আপনার নেককার মকবুল নামাযী বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। পবিত্র কুরআনের হিদায়াত আমাদের নসীব করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
[ইসলাম সম্পর্কিত পাঠকের প্রশ্নাবলি ও নানা জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি। আগ্রহীদের বিভাগের নাম উল্লেখ করে নিচের ইমেলে প্রশ্ন পাঠাতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।