শুকনা ও কাঁচা বেশ কয়েকটি পণ্যে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যবাধকতার নির্দেশ থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো পাইকারি ও খুচরা বাজার ছেয়েছে প্লাস্টিক বস্তায়। এজন্য কোম্পানির মালিক ও সরকারের নজরদারির অভাবকে দুষছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের বলেন, শতভাগ বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় বাড়াতে হবে মন্ত্রণালয়কে। গত শনিবার ৬ মার্চ দৈনিক আজাদীতে ‘পাটের বস্তার দেখা নেই, ধান, চাল চিনিসহ ১৯ পণ্য পরিবহন ও মজুদ ৯০ শতাংশই প্লাস্টিক’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনিসহ সেই ১৯ পণ্য এখনো পরিবহন ও মজুদ হচ্ছে প্লাস্টিকের বস্তায়। অথচ সরকার তিন দফা প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এসব পণ্য পাটের বস্তায় পরিবহন ও মজুদকরণ বাধ্যতামূলক করে। পরিবেশ সংরক্ষণ এবং পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে বলে জানায় পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্তারা। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরো বাজারই এখন প্লাস্টিকের বস্তায় সয়লাব হয়ে গেছে। এতে পাটের ব্যবহার বাড়াতে সরকারি উদ্যোগটাও এক প্রকার মুখ থুবড়ে পড়েছে। আবার দীর্ঘদিন ধরে প্লাস্টিক বস্তার বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযানও নেই। এই সুযোগটাই মূলত কাজে লাগাচ্ছে ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা।
পাট মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ নির্দেশ অনুযায়ী, ১৯টি কৃষি পণ্য ২০ কেজি বা এর বেশি ওজনের ব্যাগে বহন করতে হলে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কিন্তু এসব পণ্যের মধ্যে বাজারে চাল ও আলু ছাড়া অন্যান্য পণ্যে কমেনি প্লাস্টিক বস্তার ব্যবহার। নেই মনিটরিং বা ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের কোন প্রতিফলন।
এমন অবস্থাই দেখা যাচ্ছে নগরীর পাইকারী ও খুচরা বাজারে। আটা ময়দা চিনি ডালসহ বেশি ব্যবহৃত পণ্যেই দেদারসে ব্যবহার হচ্ছে প্লাস্টিক বস্তা। একই অবস্থা আমদানি করা চাল, ডাল, রসুন ও আদার বস্তায়। বিষয়টি স্বীকার করে মিল মালিকদের প্রতি দোষ চাপাচ্ছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, ‘প্লাস্টিকের বস্তা থেকে যদি চটের বস্তার দাম কমিয়ে দিত সরকার তাহলে আমরা সেটা ব্যবহার করতে পারতাম।’ মিল ফ্যাক্টরি থেকে যদি ওরা প্লাস্টিকের বদলে পাটের বস্তায় ভরে দেয় তাহলে আমাদের জন্য সুবিধা হয়।’আরেকজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘আটা এবং চিনিতে একটা পাতলা পলিথিনের ব্যাগ দিয়ে দিতে হবে।’ তবে প্রান্তিক পর্যায়ে আইনের শতভাগ বাস্তবায়ন করতে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় জোরদারের পরামর্শ অর্থনীতি বিশ্লেষকদের।
বিশ্লেষকদের মতে, স্থানীয় প্রশাসনের অংশীদারত্ব তৈরি না করতে পারলে তাহলে মাঠ পর্যায়ে এটা বাস্তবায়ন হবে না। প্লাস্টিকের বস্তা এবং পাটের বস্তার ভেতর দামের পার্থক্য বেশি থাকলে পাট ব্যবহারে আগ্রহী হবেন ব্যবসায়ীরা।’ উল্লেখ্য, পাটের বহুমুখী ব্যবহার, সমপ্রসারণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯টি পণ্যের ক্ষেত্রে চটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যবাধকতা করে সরকার। সর্বশেষ গত ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট পোল্ট্রি ও ফিশ ফিডের মোড়কে পাটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। এর আগে গত ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি সংরক্ষণ ও পরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের বস্তা ব্যবহারের নির্দেশ দেয় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। এছাড়া ২০১৭ সালের ২৪ জানুয়ারি পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, আলু, আটা, ময়দা, মরিচ, হলুদ, ধনিয়া ও তুষ-খুদ-কুঁড়ার মোড়ক হিসেবে পাটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। এদিকে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০-এর ধারা-১৪ অনুযায়ী পাটের মোড়ক ব্যবহার না করলে অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। এ অপরাধ পুনঃসংগঠিত হলে সর্বোচ্চ দণ্ডের দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
পাটের বস্তার ব্যবহার বাড়াতে পারলে মিলগুলোতে কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধি পাবে। পাট আমাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িত। পাটের জীবন রহস্য আমাদের দেশের বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছেন। দুনিয়া ব্যাপী পরিবেশবাদীরা প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। সকল দেশের পরিবেশকর্মীরা পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার জন্য লড়াই করছেন। পাট চাষ ও পাটজাত দ্রব্য উৎপাদন ও বিপণনের সাথে কোটি কোটি মানুষ জড়িত রয়েছে শত বছরেরও আগের থেকে। পাটের অর্থনৈতিক গুরুত্বের সাথে সাথে তার রয়েছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বও।
পাট ও পাট শিল্পের যে সম্ভাবনা আমাদের দেশে রয়েছে, তাকে আগাতে হলে দায়িত্ব সচেতন মহলসহ কৃষক সংগঠনসমূহকে আন্দোলনের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা হাজার হাজার পলিথিনের কারখানার মালিকরা সহজে হার মানবে না। লড়াই করেই পাট ও পাট শিল্পের সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিতে হবে।