লালদিয়া চরের মানুষের স্থায়ী ঠিকানা হোক
নিউইয়র্কের আদি নামটি কী ছিল তা আর জানার উপায় নেই। জ্ঞাত তথ্যমতে ইংল্যান্ডের ডিউক অব ইয়র্কের সম্মানে এই ব্রিটিশ কলোনির নাম রাখা হয় নিউইয়র্ক। এর আগে বলা হতো নিউ আমস্টারডাম। অনেকে বলেন ইংল্যান্ড থেকে বিতাড়িত, নির্বাসিত ও ভাগ্য অন্বেষণে আসা বসতি স্থাপনকারীরা তাদের মাতৃভূমির শহর ইয়র্কের স্মরণে শহরটির নাম রেখেছিল নিউইয়র্ক। আমেরিকা নাম থেকে শুরু করে এর অঙ্গরাজ্যের বর্তমান নাম কয়েকশ বছর আগের মাত্র।
এত দূরের উদাহরণ দেওয়ারও দরকার নেই। বান্দরবানের দর্শনীয় জায়গাগুলোর অন্যতম মেঘলা, নীলাচল, নীলগিরি ইত্যাদির প্রকৃত নাম কী তা-ও ভুলে যাবে ওই এলাকার আদি বাসিন্দারা। এখন তো চিমবুক পাহাড়ে পাঁচতারা মানের হোটেল নির্মাণের চেষ্টা চলছে। এতে ওই এলাকায় বসবাসরত ম্রো জনগোষ্ঠীর একটি অংশ বাস্তুহারা হওয়ার মুখে পড়েছে। এছাড়া কয়েকহাজার কোটি টাকার আরও বড় বড় কিছু প্রজেক্টের কাজও শুরু হতে যাচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে অনেককিছু বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে। উন্নয়নের নামে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে মুছে ফেলা, বিকৃত করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
এগুলো সবই আগ্রাসন। রাজনৈতিক আগ্রাসন, অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আগ্রাসন। হাজার হাজার বছর ধরে এমন আগ্রাসনের শিকার হয়েছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। যুদ্ধ-বিগ্রহে মৃত্যুবরণ করা ছাড়াও এই আগ্রাসনের শিকার হয়ে নিজ মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে। বাস্তুহারা হতে হয়েছে কোটি কোটি মানুষকে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের আদিবাসীরা এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছে তা অনুসন্ধান করে বলা ছাড়া উপায় নেই। কালো মানুষের দেশগুলো কীভাবে সাদা মানুষের দখলে চলে গেল। বাংলাদেশের তিনটি পার্বত্য জেলা সদরের বর্তমান অবস্থা দেখেও বোঝার উপায় নেই এই শহরগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কারা ছিল।
এখনও দেশে দেশে বসতভিটা বা ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া থেমে নেই। জোতদার না থাকলেও রাজনৈতিক প্রভাব বা টাকার জোরে কেউ কেউ দখল করে নিচ্ছে দুর্বলের সহায়-সম্পত্তি। কখনওবা সরকার উন্নয়নের নামে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করছে। বর্তমানে উন্নয়নের নামে বা পরিকল্পিত নগরায়ণের নামে মানুষকে তার বাপ-দাদার ভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় বড় নগরগুলোতে অভিজাত আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে এই প্রক্রিয়ায়। সাধারণ মানুষকে তার বাপ-দাদার ভিটে থেকে উচ্ছেদ করে সে জায়গায় বড়লোকদের জন্য বসতি গড়ে তোলা হয়েছে।
এটি শুধু বাংলাদেশে হয়েছে তা নয়। বিশ্বের আধুনিক নগরগুলো গড়ে তুলতে গিয়ে অনেককে এমন ভাগ্যই বরণ করতে হয়েছে। ক্ষতিপূরণ মিললেও শত শত বছরের স্মৃতিমাখা জন্মস্থান কেউ ফিরে পায়নি।
উন্নয়নের খাতিরে এমন উচ্ছেদেরও প্রয়োজন আছে তা স্বীকার না করে উপায় নেই। যেমন চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিষ্ঠা ও এর সমপ্রসারণের জন্য জমি অধিগ্রহণ না করে উপায় নেই। তেমনি বিমানবন্দর, ইপিজেড প্রতিষ্ঠা, সড়ক সমপ্রসারণে জমি অধিগ্রহণ করতেই হবে। কিন্তু সে কাজ করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা ন্যায্য দাম বা ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তারা অন্যত্র পুনর্বাসনের সুযোগ পাচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করতে হবে।
সমপ্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের জায়গা(?) লালদিয়ার চর থেকে কয়েক হাজার পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। মাননীয় হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী বন্দর কর্তৃপক্ষ এই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে, পতেঙ্গা এলাকার বোট ক্লাবের পাশে কর্ণফুলী নদীর পার ঘেঁষে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ৫২ একর জমির প্রায় পুরোটাই লালদিয়া চর হিসেবে পরিচিত। এই চরেই বন্দর কর্তৃপক্ষ পণ্য ওঠানামার টার্মিনাল করার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে না পেরে বছরের পর বছর অপেক্ষা শেষে শেষ পর্যন্ত ওই প্রকল্প থেকে সরে আসে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এখন ওই লালদিয়া চরে নির্মিতব্য টার্মিনালে কনটেইনার রাখার স্থান হিসেবে কাজে লাগাবে বন্দর কর্তৃপক্ষ। কর্ণফুলী নদীর দখল-দূষণ নিয়ে অনেক আন্দোলন সংগ্রামের মুখে হাইকোর্ট শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু নির্দেশনা দিতে বাধ্য হয়। এরমধ্যে লালদিয়ার চর দখলমুক্ত করা অন্যতম। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া চরে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর সব প্রস্তুতিই নিয়ে রেখেছিল কর্তৃপক্ষ। অভিযান শুরুর আগেই নিজেদের উদ্যোগে মালপত্র সরিয়ে নেয় সেখানকার বাসিন্দারা। কোনো বাধা ছাড়াই অবশেষে লালদিয়া চর চট্টগ্রাম বন্দরের দখলে এসেছে। অভিযান শুরুর দুই দিন আগেও মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন করে পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ অভিযানের প্রতিবাদ করে আসছিল আন্দোলনকারীরা। বিষয়টি মাথায় রেখে পাঁচজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে র্যাব, পুলিশ ও আনসার নিয়ে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার প্রস্তুতি ছিল বন্দরের। বুলডোজার, ট্রাক প্রস্তুত ছিল; সম্ভাব্য ঝামেলা এড়াতে বিমানবন্দর সড়ক দিয়ে যান চলাচল পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের বাধা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবেই উচ্ছেদ কার্যক্রম শেষ হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান উচ্ছেদ অভিযানের পরপর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের পুরো প্রস্তুতি ছিল অভিযান চালানোর, কিন্তু লালদিয়াবাসী নিজেদের উদ্যোগেই শান্তিপূর্ণভাবে চলে গেছে। একটি ঢিল পর্যন্ত ছোড়েনি। এরই মধ্যে ৯০ শতাংশ লোক চলে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ৫২ একর জমিতে বেড়া দিয়ে দিচ্ছি। পরবর্তী সময়ে স্থায়ী দেয়াল দেওয়া হবে। আর নিরাপত্তার দায়িত্ব নিশ্চিত করবে আনসার বাহিনী।’
লালদিয়ার চর পুনর্বাসন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আলমগীর হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘লালদিয়ার চরের অনেক লোক শনি ও রবিবার এলাকা ছাড়ে। এই উচ্ছেদ নিয়ে আমাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তাতে মনে হলো আমরা বাংলাদেশের নাগরিকই নই।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০ দিন ধরে প্রশাসনকে আমরা নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। অসহায় মানুষের আর্তনাদ শোনেনি কেউ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আকুল আবেদন, অসহায় মানুষদের পুনর্বাসন করুন। নিজ দেশে তাদের গৃহহীন করবেন না।’ প্রতিরোধ করার ঘোষণা দিয়েও সরে আসার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন দিক থেকে যেভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছিল, তাতে আমাদের উচ্ছেদ মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।’
জানা গেছে, লালদিয়া চরটি বছরের পর বছর চট্টগ্রাম বন্দরের হাতছাড়া ছিল। লালদিয়া চরের পাশে বিশাল একটি এলাকা অবৈধ উচ্ছেদের পর বন্দর থেকে সেটি লিজ দেওয়া হয় ইনকনট্রেড নামের প্রতিষ্ঠানকে। এর পাশেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে কর্ণফুলী নদীর পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতে রিট করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রায়ে অবৈধ সব স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দিলে বিভিন্ন জটিলতায় সেটি পিছিয়ে যায়। আগামী ৯ মার্চের মধ্যে অবৈধ দখল উচ্ছেদ শেষ করে উচ্চ আদালতকে জানানোর নির্দেশনাও ছিল।
লালদিয়ার চরের বাসিন্দারা বলছেন, তাদের নিষ্কণ্টক জায়গার পরিবর্তে ৪০০ পরিবারকে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে লালদিয়ার চরে জায়গা দেওয়া হয়েছিল ১৯৭২ সালে। অনেক বয়স্ক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেছেন, ১৯৭২ সালে জাতির পিতার কথায় আমরা বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে এই চরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এক বয়স্ক নারী চোখের জল মুছতে মুছতে বলছিলেন, ‘এ দেশে রোহিঙ্গাদের থাকার জায়গা হয় আমাদের সেটুকুও নাই।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে এ পর্যন্ত কয়েকবার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার জমি অধিগ্রহণ করেছে ওই এলাকার।
আমরা জানি না উদ্ধার করা এই জায়গা বন্দর তার নিজের কাজে ব্যবহার করবে না কি ব্যক্তিগতখাতে ছেড়ে দেবে। এমন নজির থাকায় অনেকে সন্দেহের চোখে দেখছেন উচ্ছেদ অভিযানকে। যদিও দাবি অনুযায়ী কর্ণফুলীতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়নি। শাহ আমানত সেতুর আশেপাশে এবং চাক্তাই খালের মুখে দখল হওয়া নদীর জায়গা পুরোপুরি দখলমুক্ত করতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসন।
পাহাড়ের ম্রো জনগোষ্ঠী আর লালদিয়া চরের মানুষদের নিয়তির চক্র আজ এক বিন্দুতে এসে মিশেছে। নিজেদের বাস্তুভিটা হারিয়ে ঠিকানাহীন মানুষে পরিণত হতে যাচ্ছে তারা। এটা অপরাধ। এই অপরাধ করতে দেওয়া যায় না। অন্তত স্থায়ী ঠিকানা নিশ্চিত না করে কাউকে বাস্তুহারা করা যাবে না এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করুক রাষ্ট্র।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক