অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ হত্যাকাণ্ডের পর কক্সবাজার জেলা পুলিশের সকল (ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে স্যুইপার পর্যন্ত) সদস্যকে একযোগে বদলি করা হলেও সেই গণবদলি থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন এসআই নুর-ই খোদা সিদ্দিকী। তবে গণবদলি থেকে বাঁচলেও তিনি থেমে থাকেননি, চাঁদাবাজি করে গেছেন নিয়মিত! এমনটাই অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। সর্বশেষ কুতুবদিয়া পাড়ায় ঘরে ঢুকে রোজিনা খাতুন নামের এক নারীর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তিন লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় কক্সবাজার শহর পুলিশ ফাঁড়িতে সম্প্রতি যোগ দেওয়া এই পুলিশ কর্মকর্তার কাহিনী এখন সবার মুখে মুখে।
স্থানীয়রা জানান, কক্সবাজারে পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে জেলার সবক’টি সার্কেল ও থানায় নতুন কর্মকর্তাসহ পুলিশ কনস্টেবল যোগ দেওয়ার পাঁচমাস অতিবাহিত হয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযোগ শোনা না যাওয়ার পাশাপাশি সর্ববৃহৎ ইয়াবার চালান ও বস্তাভর্তি টাকা জব্দ করে তারা নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। তবে গত ১ মার্চ কক্সবাজার শহর পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুর-ই খোদা সিদ্দিকী, কনস্টেবল আমিনুল মোমিন ও মামুন মোল্লা টাকা ছিনতাইয়ে নিজেদের জড়িয়ে পুলিশের ভাবমূর্তি ফের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। এর আগে নানা অভিযোগ উঠার পর কঙবাজার জেলা পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান চকরিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুর-ই খোদা সিদ্দিকীকে সপ্তাহ খানেক আগে চকরিয়া থানা থেকে কঙবাজার শহর পুলিশ ফাঁড়িতে বদলি করেন। সেখানে যোগ দিয়েই নুর-ই খোদা জড়িয়ে পড়ে ছিনতাইয়ে। বিষয়টি বেশ আলোচিত হওয়ার পর চকরিয়ার ভুক্তভোগী লোকজনও মুখ খুলতে শুরু করেন।
চকরিয়া লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের আইয়ুব মো. ইকবাল বলেন, জায়গার নিয়ে বিরোধের জেরে ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর আমার ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ওই হামলায় আমার একটি দাঁত পড়ে যায় এবং আমি রক্তাক্ত জখম হই। এ ঘটনায় আমি বাদী হয়ে থানায় মামলা রুজু করতে এজহার দায়ের করলে সেটি তদন্তের দায়িত্ব পান এসআই নুর-ই খোদা সিদ্দিকী। এরপর সরজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মামলা রুজু করে দেওয়ার কথা বলে তিনি দুই দফায় ১৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। এমনকি আমার প্রতিপক্ষের সাথে আঁতাত করে উল্টো আমিসহ পরিবার অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে সহায়তা করেন। এতে আমি নিজেসহ পরিবারের অন্যান্যরা হয়রানির মুখে পড়ি।
ভুক্তভোগী আইয়ুব মো. ইকবাল আরো অভিযোগ করে বলেন, পাল্টা মামলায় আসামি হয়ে যাওয়ার পর আমি থানায় যেতে না পারিনি। এজন্য আমার স্ত্রী আশরাফুন্নেছা থানায় গিয়ে ওসির কাছে এসব বিষয় খুলে বলেন। কিন্তু এরপর থেকে উল্টো নুর-ই খোদার হুমকি-ধামকিতে তটস্থ হয়ে পড়ি আমরা।
নাম প্রকাশে অনিশ্চুক খুটাখালীর এক যুবলীগ নেতা বলেন, আমার নিকটাত্মীয়ের একটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করার বিপরীতে এসআই নুর-ই খোদা সিদ্দিকী নগদ ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু টাকা নেওয়ার পরও তিনি মামলার প্রতিবেদন না দিয়ে উল্টো বকাঝকা করতে থাকেন। শেষপর্যন্ত বিষয়টি সিনিয়র এক নেতার দৃষ্টিগোচর করলে চকরিয়া থেকে বদলি হওয়ার কয়েকদিন আগে তিনি প্রতিবেদন দাখিল করেন।
ডুলাহাজারা ইউনিয়নের জনৈক বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি হামিদুল হক অভিযোগ করে বলেন, পারিবারিক বিরোধ ও আমার ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে আদালতে একটি মামলা করি। আদালতের নির্দেশে ওসি সেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেন এসআই নুর-ই খোদা সিদ্দিকীকে। তদন্তের দায়িত্বভার পাওয়ার পর থেকে নুর-ই খোদা সিদ্দিকী যাচ্ছেতাই খারাপ আচরণ শুরু করেন। দাবি করেন মোটা অংকের টাকা। শেষ পর্যন্ত আমার কাছ থেকে টাকা না পেয়ে মামলার অভিযুক্তদের সাথে আঁতাত করেন। এমনকি অভিযুক্তদের কাছ থেকে নগদ তিনলাখ টাকা নিয়ে উল্টো আমার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিলের সবকিছুই চূড়ান্ত করেন। বিষয়টি জানার পর সরাসরি আমি থানার ওসি শাকের মোহাম্মদ যুবায়েরের কাছে যাই। বিষয়টি শোনার পর তিনি পুনঃতদন্তের জন্য দায়িত্ব দেন থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আশরাফ হোসেনকে।
এদিকে চকরিয়া পৌরশহরের বেশ কয়েকটি অভিজাত রেস্তোরাঁ ও আবাসিক হোটেলের মালিক ও কর্মচারীরা জানান, পুলিশ কর্মকর্তা নুর-ই খোদা সিদ্দিকী প্রতিনিয়ত নারী নিয়ে তাদের রেস্তোরাঁয় যেতেন এবং একান্তে সময় কাটাতেন। যেসব নারী নিয়ে তিনি হোটেলে যেতেন তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন মামলার বাদী বা বিবাদী পক্ষের লোকজন।
চকরিয়া থানা থেকে হঠাৎ নুর-ই খোদা সিদ্দিকীর বদলি হলো কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাকের মোহাম্মদ যুবায়ের বলেন, আমরা যারা নতুন যোগদান করেছি, তারা সেবা প্রদানের মাধ্যমে জনগণের মন জয়ের চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার কাছে অনেকে মৌখিকভাবে নুর-ই খোদা সিদ্দিকীর ব্যাপারে নানা অভিযোগ করতেন। পরে বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করি। পরবর্তীতে তাকে এখান থেকে বদলি করা হয়।
চকরিয়া সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মো. তফিকুল আলম বলেন, নতুন বা পুরনো পুলিশের যে সদস্য অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াবেন তাকে অবশ্যই কঠিন শাস্তি পেতে হবে। যা ইতোমধ্যে নুর-ই খোদা সিদ্দিকীর বেলায় ঘটেছে।