মানুষের জীবনে ছয়টি রিপু আছে। আমরা এটিকে সাধারণভাবে ষড়রিপু বলে। ষড় এর অর্থ ছয়, রিপু এর অর্থ শত্রু। এই ছয়টি শত্রু মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে বাধা দেয়। প্রতিটি মানুষের পিছনে ছয়টি শত্রু রয়েছে যাকে বলা হয় ষড় রিপু- ১. কাম – যৌন সঙ্গকামনা বা যৌনক্ষুধা। ২. ক্রোধ – রাগ, উত্তেজনার বশীভূত হওয়া। ৩. লোভ – লালসা বা কোন কিছুর জন্য লালায়িত হওয়া ৪. মোহ – মায়া বা বিভ্রম ৫. মদ – অহংকার, গর্ব, আত্মগৌরব ৬. মাৎসর্য – পরশ্রীকাতরতা, অন্যের ভালো দেখতে না পারা। এই ছয়টি রিপু স্থান কাল পাত্র ভেদে মানুষের জীবনে যতটা সম্ভব পরিত্যাজ্য। এই ষড়রিপুর একটি হচ্ছে ক্রোধ। ক্রোধের অপর নাম রাগ। মানুষ ক্রোধ রিপুর বশবর্তী হয়ে অতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে, যার ফলশ্রুতিতে নিজের জীবনে সংসারে সমাজে অশান্তি বয়ে আনে। তাই ক্রোধ কে সংবরণ করে ধৈর্য ধারণ করাই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞানীর পরিচয়। ক্রোধ খুবই খারাপ একটি রিপু, ক্রোধ রিপুকে বশীভূত করতে না পারলে জীবনের কোন কাজেই সফলতা আসে না, ক্রোধ রিপুকে বশীভূত করতে হলে ধৈর্য, সহনশীলতা ও ক্ষমা গুণের অধিকারী হতে হয়। রাগ হচ্ছে ধ্বংসাত্মক বা ক্ষতিকারক দিক আর অনুরাগ হচ্ছে সৃজনশীলতা ও কোন মহৎ উদ্দেশ্য বা সাধনা বাস্তবায়নের সোপান স্বরূপ। মানুষের নেতিবাচক ষড়রিপুর মধ্যে ক্রোধ বা রাগ হচ্ছে একটি। ষড়রিপু ছয়টি হলো কাম, ক্রোধ, লোভ মোহ ইত্যাদি। সত্যিকারের এক মানবিক মানুষ হিসাবে গড়ে উঠার ক্ষেত্র এই ষড়রিপু থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকাই উত্তম। কথায় বলে ‘রাগ করলেই তো হেরে গেলেন।’ রাগ মানুষের সহজাত একটি আচরণ। আচরণের মধ্যেই রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। নানা কারণে মানুষ রাগান্বিত হয়। মানুষের স্বভাব চরিত্রের ধরন অনুযায়ী রাগান্বিত হওয়ার মধ্যে পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। ক্রোধ হচ্ছে প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা। কারো প্রতি কোন প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মনের মধ্যে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় তাকে ক্রোধ বলতে পারি। পিথাগোরাস বলেছেন, ‘ক্রোধ দুর্বুদ্ধি থেকে শুরু হয়ে অনুশোচনায় সমাপ্ত হয়।’ এ সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে ক্রোধের নেতিবাচক দিকই উন্মোচিত হয়। ক্রোধ সাময়িক ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু কোন ব্যক্তি যখন ক্ষোভটা নানাভাবে প্রকাশ করে ফেলেন তার সুদূরপ্রসারী ফল নেতিবাচক। এই জন্য পিথাগোরাস বলছেন ‘ক্রোধ হয় দুর্বুদ্ধি থেকে এবং সে ক্ষোভ প্রকাশ করাতে এক সময় তাকে অনুশোচনায় পুড়তে হয়। প্রকৃত পক্ষে তখন করার কিছুই থাকে না।’ সমাজে অনেকগুলো অপরাধের মূল কারণ ক্রোধকে সংবরণ করতে না পারা। অশিক্ষিত মানুষের মধ্যেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে বেশি। আবার শিক্ষিতজনের মধ্যেও যে ঘটে না সে রকম নয়। শিক্ষিত লোকের মধ্যেও এর প্রকাশ দেখা যায়। তবে শিক্ষিত লোকরা যতটা তার ক্রোধকে সংযত রাখতে পারেন অশিক্ষিতরা তেমনটি পারেন না। এখানে শিক্ষার একটা ব্যাপার আছে। সমাজে এমন কিছু কূটিল মানুষ আছে দেখবেন, যারা নানা ঘটনা প্রবাহে আপনার চারপাশে এমনসব পরিবেশে পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে যাতে আপনি নিজেই ক্রোধান্বিত হয়ে উঠেন বা রাগান্বিত হয়ে উঠেন। বুদ্ধিমত্তার সহিত বিষয়টি মোকাবেলা করতে হয়। তা না হলে নিজেই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। বিভিন্ন হানাহানি, মারামারি, খুনোখুনির ঘটনা পর্যন্ত ঘটে এই ক্রোধ থেকে। ক্রোধ মানুষের বিবেকবোধকে লুপ্ত করে খারাপ কাজ করতে প্রলুব্ধ করে। স্বাভাবিক মানুষকে ক্রোধ ধীরে ধীরে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে। ক্রোধ মানুষকে এমন মন্দ কাজ করার প্রেরণা জোগায়, সে একসময় সে হঠাৎই এমন অন্যায় কাজ করে ফেলে, যার পরিণামে নিজেই অনেক ক্ষতির মধ্যে নিপতিত হন এবং একসময় লজ্জারও সম্মুখীন হতে হয়। মানুষের মধ্যে জন্মগতভাবেই রাগের স্বভাব থাকে আবার অনেকের মধ্যে থাকে না। অনেকেই অত্যন্ত ধৈর্যশীল হয়ে থাকেন। অতিরিক্ত রাগের কারণে কত মানুষকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে তার হিসাব মেলানো দুরূহ। রাগের সর্বশেষ পরিণতি অনুশোচনা। ক্রোধ বা রাগ মানুষের সহজাত একটি প্রবৃত্তি। অনেকেই হঠাৎ করে সামান্য কিছুতেই রেগে যায়। এই রাগ তার শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনে। এটি তার মনন ও স্বাভাবিক জীবন চলার স্বাভাবিক চলার পথে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ক্রোধ অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিশেষ যা ঝগড়া-বিবাদসহ নানা ধরনের সংঘাত বিরোধের জন্ম দেয়। ক্রোধ মানুষের মনে প্রতিশোধের যে আগুনের জন্ম দেয় যে জ্বেলে দেয় তা শেষ পর্যন্ত নানা অপ্রীতিকর ঘটনার সূত্রপাত ঘটায়, যা খুনখারাবি পর্যন্ত ঘটিয়ে ফেলে। ক্রোধান্বিত হয়ে অনেক অন্য মানুষের প্রতি নানা রকম জুলুম করে, প্রচণ্ড বাড়াবাড়ি করে, গালাগালাজ করে। অনেক সময় রাগে বেসামাল হয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যেও বিবাদ সৃষ্টি হয় এবং এর তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়। ফলে একটি সাজানো-গোছানো সুখের সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। হঠাৎ ক্রোধের ভুল কারণে হয়তো সে মানুষ সারাজীবন অনুতাপে নিপতিত হয়। মানুষের প্রতি হিংসা, নিন্দা বা সমালোচনার পেছনেও এই রাগের প্রবল একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং রাগকে সংযত রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। তবে ক্রোধকে যতই নেতিবাচক হিসাবে দেখি না কেন, কোন কোন ক্ষেত্রে কিছুটা ক্রোধ ইতিবাচকও হয়। অর্থাৎ সব ক্ষেত্রে ক্রোধ পরিহার প্রশংসনীয় নয়। বরং কখনো কখনো ক্রোধের প্রয়োজন রয়েছে। যেমন- ছেলেমেয়ে বা পরিবার পরিজন কিংবা অধীনস্থ কাউকে অন্যায় বা ভুল কেন কাজ করতে দেখলে প্রয়োজনীয় সংশোধনের জন্য রাগ প্রদর্শন ও শাসনের প্রয়োজন আছে কিংবা রাগান্বিত হবার অভিনয় করারও যৌক্তিকতা আছে। কারণ অন্যায় বা অবৈধ কাজকে প্রশ্রয় দিলে তার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। মানুষের মধ্যে আচরণগত যে পার্থক্য কেউ অল্পতে রেগে যায়, কেউ সহজে রাগই করে না। রাগ মানুষের সঙ্গে মানুষের সৌহার্দ্য ও সুসম্পর্ক নষ্ট করে। মানুষের মনের শান্তিকে বিনষ্ট করে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ক্রোধের সময় দেহে ব্রেন সিগন্যাল পাঠায়। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়, গভীর হয়। রক্তচাপ বেড়ে যায়। চোখের মণির স্ফীতি ঘটে। দেহের অন্যান্য অংশ থেকে রক্তপ্রবাহ দ্রুত ছুটে আসে হৃদপিণ্ডে, ব্রেন ও পেশির দিকে। হজমক্রিয়া থেমে যায়। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। হাতের মুঠি বন্ধ হয়ে আসে, দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে আসে, পরিপাকতন্ত্র খামছে ধরে। মূলত ক্রোধের সময় দেহমনে জেগে ওঠে ডেঞ্জার সিগন্যাল বা লালবাতি। ‘ম্যানেজিং এঙ্গার’ নামক এক গ্রন্থের লেখক গিললিনডেন ফিল্ডের মতে, ‘রাগ হচ্ছে দেহের স্বাভাবিক আবেগীয় ও দৈহিক প্রতিক্রিয়া। যখন কেউ হুমকির মুখোমুখি হয় তার রাগ হতেই পারে।’ ক্রোধ দমনে নতুন কিছু কৌশলকে নিজের মধ্যে ধারণ করা যেতে পারে যার ফল হতে ইতিবাচক। আমরা যতই রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো ততই আমাদের সামাজিক পারিবারিক শান্তির বিস্তার ঘটবে। রাগ বা ক্রোধ কিন্তু কোনো অর্থেই ভালো কিছু বয়ে আনে না। পারিবারিক, সামাজিক, সমাজ, সংসার, ব্যক্তি- ব্যক্তিতে সম্পর্কসহ নানাবিধ সম্পর্কে নানা সমস্যার উদ্রেগ ঘটাতে পারে অতিরিক্ত রাগ। অনেক গবেষকরা বলছেন, রাগকে যদি আপনি সময়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাহলে অনেক ইতিবাচক বিষয়ের জন্ম হয়, যা জীবন যাত্রায় অনেক অর্থপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ।