চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ষষ্ঠ নির্বাচিত পরিষদের প্রথম সাধারণ সভা বর্জন করেছে সংস্থাটির প্রকৌশলীরা। মঞ্চে প্রধান প্রকৌশলীকে বসতে না দেয়ার প্রতিবাদে সভাস্থল ত্যাগ করেন তারা। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত নগরের থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। সভায় ‘ডোর টু ডোর’ ময়লা-আর্বজনা অপসারণ কার্যক্রম বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া, পৌরকর আদায়ে কাউন্সিলরদের সঙ্গে সমন্বয় করা, মশক নিধন অকার্যকর কেন তা খতিয়ে দেখা, কাউন্সিলরদের কাজের সীমারেখা বিষয়ে কর্মশালা আয়োজন, স্থায়ী কমিটি গঠন এবং উন্নয়ন কাজের মান নিশ্চিতে ঠিকাদারকে বিল দেয়ার পূর্বে কাউন্সিলরদের সম্মতি নেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া আগামী এক মাসের মধ্যে স্থায়ী কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভায় উপস্থিত একাধিক কাউন্সিলর দৈনিক আজাদীকে বিষয়গুলো নিশ্চিত করেছেন।
প্রকৌশলীদের সভা বর্জন : প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মঞ্চে মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিবের বসার জন্য আসন দেয়া হয়। প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল সোহেল আহমদ সভাস্থলে প্রবেশ করে মঞ্চে আসন দেখতে না পেয়ে বের হয়ে যান। এ সময় তাকে অনুসরণ করে সেখানে উপস্থিত অন্য প্রকৌশলীরাও বের হয়ে যান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আজাদীকে বলেন, সভাস্থলে প্রবেশ করার সময় দেখলাম প্রধান প্রকৌশলী স্যার বের হয়ে যাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করতেই স্যার বললেন, সাধারণ সভায় থাকব না, সবাই চলো। এরপর আমরাও বের হয়ে গেলাম। চসিকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অতীতে সাধারণ সভায় মঞ্চে মেয়র, প্রধান নির্বাহী ও সচিবের পাশাপাশি প্রধান প্রকৌশলী, মেয়রের পিএস (সিনিয়র সহকারী সচিব) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা বসতেন। এমনকি মঞ্চের দ্বিতীয় সারির আসনে কোনো কোনো সময় প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তারাও বসতেন।
সভা বর্জনের বিষয়ে একাধিকবার ফোন করলেও প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল সোহেল আহমদের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক আজাদীকে বলেন, চলে যাওয়ার বিষয়টি আমি জানতাম না। পরে শুনেছি। কেন চলে গেছেন ঠিক জানি না। এ বিষয়ে আমার সাথে কথা হয়নি এবং শেয়ারও করেননি।
মঞ্চে আসন রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে আলাপ করেই সবকিছু করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, মেয়র ও প্রধান নির্বাহী থাকবেন এবং সভায় সার্বিক কার্যক্রমে সহযোগিতার জন্য সচিব থাকবেন। আইনে যেভাবে বলা আছে। তাছাড়া মঞ্চে অত বেশি লোক থাকার প্রয়োজন নাই।
ডোর টু ডোর প্রকল্প বেসরকারি খাতে : ২৫ নং রামপুর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুস সবুর লিটন প্রস্তাব করেন, বাসা-বাড়ি থেকে সরাসরি ময়লা-আবর্জনা অপসারণ কার্যক্রমের ‘ডোর টু ডোর’ প্রকল্প বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হোক। একইসঙ্গে গৃহকর আদায় কার্যক্রমের সাথে কাউন্সিলরদের সমন্বয় করা হোক।
বিষয়টি নিশ্চিত করে আব্দুস সবুর লিটন আজাদীকে বলেন, প্রতি পাঁচ বছর পরপর মেয়র পরিবর্তন হয়। নতুন মেয়র দায়িত্ব নিলে পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম বিষয়ে জনবল সংকটের কথা বলা হয়। এবারও বলা হলো। অথচ সাবেক মেয়রের আমলে দুই হাজারের বেশি লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাই আমি প্রস্তাব দিয়েছি, ডোর টু ডোর কার্যক্রম বাস্তবায়নে যেন ৪১ ওয়ার্ডে বেসরকারিভাবে লাইসেন্স দেয়া হয়। লাইসেন্স দিলে সিটি কর্পোরেশন আর্থিকভাবে লাভবান হবে। আবার যারা লাইসেন্স পাবে তারা প্রতিটি বাসা-বাড়ি থেকে তাদের লোকজন দিয়ে ময়লা সংগ্রহ করবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি বাসা-বাড়ি থেকে মাসে ২০/৩০ টাকা নিতে পাবে। এতে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এবং জনগণেরও সমস্যা হবে না। ঢাকায় কিন্তু এটার প্রচলন আছে। এখন যে পদ্ধতিতে ময়লা সংগ্রহ করা হয় তাতে সাধারণ লোকজনের অভিযোগ আছে। পরিচ্ছন্নকর্মীরা একদিন আসলে দুদিন আসে না।
গৃহকর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যারা হোল্ডিং ট্যাক্স নেয় তারা পাঁচ হাজার টাকা আদায় করে অনেক সময় দুই হাজার টাকা জমা করে বলে অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে কাউন্সিলরদের সঙ্গে সমন্বয় করলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। ট্যাক্স যারা আদায় করবে তারাই টাকাটা আইন অনুযায়ী কর্পোরেশনের ফান্ডে জমা করবে। কেবল সমন্বয় করবে কাউন্সিলরের সাথে।
উন্নয়ন কাজে কাউন্সিলরদের স্বাক্ষর ক্ষমতা : চসিকের জনসংযোগ শাখা থেকে পাঠানো সাধারণ সভা সংক্রান্ত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, সভায় মেয়র কাউন্সিলরদের উদ্দেশে বলেছেন, ঠিকাদাররা ওয়ার্ডে যে কাজগুলো করছে তা তাদের যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে। কাজের মান বিচার তারাই করবেন। কাজের মান নিয়ে কাউন্সিলরদের সম্মতি মন্তব্য ছাড়া ঠিকাদাররা বিল পাবেন না।
এদিকে গত ৪ জানুয়ারি বিধিসম্মত না হওয়ায় ঠিকাদারের দাখিলকৃত উন্নয়ন কাজের বিলে ওয়ার্ড কাউন্সিলদের সুপারিশ বা সম্পৃক্ততা বন্ধে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলো নির্দেশনা দিয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের বিপরীতে ঠিকাদার কর্তৃক দাখিলকৃত বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সুপারিশ গ্রহণ করা হয়ে থাকে মর্মে জানা যাচ্ছে। কিন্ত এ ধরনের রেওয়াজের সমর্থনে সরকারের কোনো নির্দেশনা ও পরিপত্র নাই। এ জাতীয় কার্যক্রম বিধিসম্মত নয় এবং এর ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়া বা সেবা গ্রহীতা নাগরিকদের হয়রানির সুযোগ সৃষ্টি হয়’।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, একসময় এলাকার উন্নয়ন কাজ তদারকি করতেন স্থানীয় কাউন্সিলরগণ। পরবর্তীতে ঠিকাদারের উপস্থাপিত বিলের ফাইলে সুপারিশ বা স্বাক্ষর করতেন তারা। ২০১৫ সালে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আ.জ.ম নাছির উদ্দীন দীর্ঘদিনের এ সংস্কৃতি বাদ দেন।
কর্মশালা ও জন্মনিবন্ধন জটিলতা : সার্ভার বন্ধ থাকায় জন্মনিবন্ধন সনদ প্রাপ্তিতে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনের প্রস্তাব দেন ৩৩ নং ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব। তিনি বলেন, সার্ভার বন্ধ থাকায় অনলাইনে জন্মনিবন্ধন সনদ আপলোড করা যাচ্ছে না। এতে অনেকের সমস্যা হচ্ছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করে সমস্যা দূর করার প্রস্তাবনা দিয়েছি। তাছাড়া সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য মা-বাবার জন্মনিবন্ধন সনদের কপি লাগবে বলা হচ্ছে। কিন্তু যাদের মা-বাবা মারা গেছেন বা বয়স্ক অনেক মা-বাবা সনদ নেননি। তাহলে তাদের সন্তানরা কি পাবে না? বিষয়গুলো কী করা যায় সে বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছি। নির্বাচিত কাউন্সিলরদের নিজের কর্মপরিধি সম্পর্কে জানার সুবিধার্থে কর্মশালা আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছি।
৮ নং পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবারক আলী শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক স্থায়ী কমিটি একসাথে না রেখে আলাদা করার প্রস্তাবনা দেন।
অন্যান্য সিদ্ধান্ত : সাধারণ সভায় কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক বলেন, মেয়র মহোদয়ের ১০০ দিনের কর্মসূচি প্রসঙ্গে সবার মতামত নিয়েছি। কীভাবে কাউন্সিলরগণ সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করা যায় সেই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এক মাসের মধ্যে স্থায়ী কমিটি গঠন এবং প্যানেল মেয়র নির্র্বাচন নিয়েও কথা হয়েছে।