দশ বছরে মৃত্যু ১০১৮ বাংলাদেশি শ্রমিকের

মারা গেছে ৬৫০০ দক্ষিণ এশীয়।। কাতার বিশ্বকাপ

আজাদী ডেস্ক | বুধবার , ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

কাতার বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হওয়ার ভোটাভুটিতে জেতার পর থেকে গত ১০ বছরে দেশটিতে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি অভিবাসী শ্রমিক মারা গেছে বলে জানিয়েছে গার্ডিয়ান। এদের মধ্যে অন্তত ১ হাজার ১৮ জন বাংলাদেশি। বিভিন্ন দেশের সরকারি উৎসগুলো থেকে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেছে বলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটির এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
২০১০ সালের ডিসেম্বরের এক রাতে বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হওয়ার দৌড়ে কাতারের জয়ে যখন দেশটির সড়কগুলোতে উল্লসিত জনতা উৎসব করছে সেই সময় থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার এই পাঁচটি দেশের গড়ে ১২ জন করে শ্রমিক প্রতি সপ্তাহে মারা গেছে। খবর বিডিনিউজ ও বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার।
গার্ডিয়ান জানিয়েছে, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ২০১১ থেকে ২০২০ সময়ের মধ্যে কাতারে ওই দেশগুলোর ৫৯২৭ জন অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতের শ্রমিক। গত ১০ বছরে কাতারে ২ হাজার ৭১১ জন ভারতীয় শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এরপর নেপালের ১ হাজার ৬৪১ জন, বাংলাদেশের ১ হাজার ১৮ জন এবং শ্রীলঙ্কার রয়েছে ৫৫৭ জন। এছাড়া পাকিস্তান দূতাবাসের হিসাবে ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে তাদের ৮২৪ শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন।
মৃত্যুর মোট সংখ্যাটি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। কারণ এর সঙ্গে অন্যান্য যেসব দেশ কাতারে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক পাঠিয়েছে তাদের (ফিলিপিন্স ও কেনিয়া) মৃতদের যোগ করা হয়নি। ২০২০ সালের শেষ দিকে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদেরও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
গত ১০ বছরে কাতার প্রধানত ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে অভূতপূর্ব নির্মাণ কর্মসূচি শুরু করেছে। নতুন সাতটি স্টেডিয়ামের পাশাপাশি বহু বড় প্রজেক্টের নির্মাণ ইতোমধ্যে শেষ করা অথবা হওয়ার পথে। এর মধ্যে আছে নতুন বিমানবন্দর, সড়ক, গণপরিবহন ব্যবস্থা, হোটেল ও নতুন শহর, এগুলো সবই বিশ্বকাপের অতিথিদের বরণ করে নেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
উপসাগরীয় দেশগুলোতে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ফেয়ারস্কয়ার প্রজেক্টের পরিচালক নিক ম্যাকগিহান জানান, মৃত্যুর রেকর্ডগুলো পেশা ও কাজের স্থান অনুযায়ী তালিকাবদ্ধ করা না হলেও যারা মারা গেছেন তাদের অনেকেই বিশ্বকাপের অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে কাজ করতেন এটি ধরে নেওয়া যায়।
তিনি বলেন, ২০১১ থেকে যে সব অভিবাসী শ্রমিকরা মারা গেছেন তাদের খুব উল্লেখযোগ্য একটি অংশ শুধু এই দেশটিতেই ছিলেন, কারণ কাতার বিশ্বকাপের আয়োজক দেওয়ার হওয়ার দৌড়ে জিতেছিল। বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম নির্মাণ কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকা শ্রমিকদের মধ্যে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৪ জনের মৃত্যু ‘কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত কারণে’ হয়নি বলে বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটি শ্রেণিবদ্ধ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা এসব শব্দের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ কয়েকটি ঘটনায় কর্মস্থলে থাকাকালে মৃত্যুকে বর্ণনা করতেও এটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে এমন বেশ কয়েকজন শ্রমিক আছেন যারা স্টেডিয়াম নির্মাণস্থলেই সংজ্ঞা হারিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
এসব তথ্য তাদের দেশে থাকা ২০ লাখ অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষায় কাতার যে ব্যর্থ হয়েছে সেটিই তুলে ধরছে। মূলত তরুণ শ্রমিকদের এই উচ্চ মৃত্যুর কারণ তদন্ত করতেও ব্যর্থ হয়েছে কাতার। মৃত্যুর এসব পরিসংখ্যানের পেছনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বহু পরিবারের কাহিনী আছে। যারা তাদের পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়েছেন। এসব পরিবার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য ধর্না দিচ্ছেন আর অনেক পরিবার তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর পরিস্থিতি নিয়েও বিভ্রান্ত হয়ে আছে।
বাংলাদেশ থেকে আসা মোহাম্মদ শহীদ মিয়া শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত তার বাসস্থানে খোলা বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে আসা মেঝেতে জমে থাকা পানি থেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান।
ভারতের মধু বোল্লাপাল্লির পরিবার বুঝেই উঠতে পারছে না কীভাবে ৪৩ বছর বয়সী স্বাস্থ্যবান লোকটি কাতারে কাজ করার সময় ‘স্বাভাবিক কারণে’ মারা গেল। তার মৃতদেহ তার শ্রমিকাবাসের মেঝেতে শায়িত অবস্থায় পাওয়া যায়।
কাতারের নির্মম মৃত্যুর এসব সংখ্যা দাপ্তরিক স্প্রেডশিটের লম্বা তালিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে কারও নামের পাশে মৃত্যুর কারণ হিসেবে উপর থেকে পড়ে একাধিক ভোতা আঘাত, ফাঁসিতে ঝুলে থাকার কারণে শ্বাসকষ্টে মৃত্যু বা কারও মৃতদেহ পচন ধরায় কারণ নির্ণয় করা যায়নি এমনটি লেখা আছে। কিন্তু যতগুলো কারণ দেখানো হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছে তথাকথিত ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’; যেখানে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ অথবা শ্বাসতন্ত্র বিকল হওয়াকে দায়ী করা হয়েছে।
গার্ডিয়ানের হাতে যেসব তথ্য এসেছে তাতে ভারতীয়, নেপালি ও বাংলাদেশি শ্রমিকদের ৬৯ শতাংশের মৃত্যুর স্বাভাবিক কারণে হয়েছে বলে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। শুধু ভারতীয় ধরলে হারটি ৮০ শতাংশ হয়।
এর আগে গার্ডিয়ানের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এ ধরনের শ্রেণিবদ্ধকরণ যা প্রায়ই কোনো ময়নাতদন্ত ছাড়াই করা হয়েছে। মৃত্যুর পেছনে বিদ্যমান বৈধ চিকিৎসাগত ব্যাখ্যা হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০১৯ সালে গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে, গ্রীষ্মকালে কাতারের তীব্র গরম সম্ভবত বহু শ্রমিকের মৃত্যুর পেছনে একটি উল্লেখযোগ্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে আরো ৫৭ জনের করোনা শনাক্ত
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণে গতি