গত বৎসর মার্চ থেকে যখন বাংলাদেশে করোনা অতিমারি শুরু হয় তখন প্রথমদিকে মানুষ যখন ঘর থেকে বের হতেই সাহস পাচ্ছিল না, নিকট আত্মীয়রা পর্যন্ত আত্মীয়ের অসুস্থতার খবর বা মৃত্যুসংবাদ শুনে এগিয়ে আসছিল না তখন চট্টগ্রামের লায়ন সদস্যরা এগিয়ে এসেছিল। লায়ন সদস্যরা গাউছিয়া কমিটির সহায়তায় করোনায় মৃত্যুবরণকারী অনেকের লাশ দাফন বা সৎকার করে এবং এখনো করছে। এ ব্যাপারে কোন জাতি ধর্ম ভেদাভেদ ছিল না। লাশ পরিবহন থেকে শুরু করে লাশ ধোয়া দাফন/সৎকার সবই করেছিল লায়ন্স ক্লাব।
গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় পিপিই ও কাফনের কাপড় সরবরাহ করেছে লায়ন্স। তাছাড়া করোনাকালে গরিবদের মধ্যে খাদ্য সহায়তা মাঙ প্রদান, ওষুধ সরবরাহ এবং শীতের শুরু থেকে কম্বল বিতরণ ইত্যাদিতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্লাব এবং লায়ন জেলা নেতৃবৃন্দ সদা ব্যস্ত ছিল। করোনাকালে লায়নদের সবথেকে বড় অবদান ছিল মা ও শিশু হাসপাতালে আইসিইউসহ ৫০ বেডের করোনা সাপোর্ট সেন্টার তৈরি করা। এ সাপোর্ট সেন্টার তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল লায়ন জেলা ৩১৫ বি৪ এর তৎকালীন গভর্নর লায়ন কামরুন মালেক ও প্রাক্তন গভর্নর আজাদী সমপাদক এম এ মালেকের। তাছাড়া তৎকালীন প্রথম ভি.ডি.জি লায়ন সুকান্ত ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় ভি.ডি.জি লায়ন শামসুদ্দিন আহমদ, লায়ন আল সাদাত দোভাষ, প্রাক্তন গভর্নর লায়ন নাজমুল হক চৌধুরী, লায়ন মনজুর আলম, লায়ন মহিউদ্দিন, লায়ন ওসমান গনি, লায়ন নিশাত ইমরান, লায়ন ডা. মেজবাহ উদ্দিন তুহিন, লায়ন জি.কে লালা, লায়ন আশরাফুল, লায়ন জাহেদুল আলম, লায়ন মোসলেহ উদ্দিন খান, লায়ন আবু নাসের রনি সহ অনেকের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অনেক লায়নের আর্থিক অনুদানের এ সাপোর্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সেন্টার সার্বক্ষণিকভাবে চট্টগ্রামের করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে আসছে। করোনাকালে লায়নরা করোনা আক্রান্ত পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা ও মানসিক সাপোর্ট দিয়ে সেবার এক অনন্য নজির স্থাপন করে চলেছে। আমিও একজন লায়ন হওয়াতে লায়নদের এই প্রচেষ্টাগুলো খুব কাছে থেকে দেখেছি। খুলশীতে অবস্থিত লায়ন্স চক্ষু হাসপাতাল ও ফিজিওথেরাপি সেন্টার মানুষের চক্ষু পরীক্ষা, অপারেশন, পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের ফিজিওথেরাপিসহ নানা সেবা দিয়ে আসছে। আরেকজন লায়নের কথা না বললেই নয় তিনি হলেন লায়ন ডা. সাদেক। যিনি করোনাকালে লায়ন পরিবার ছাড়াও অনেককে ফোনে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে সহায়তা করেছেন, যখন কোন চেম্বারে ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছিল না। করোনাকালে চট্টগ্রামের লায়নরা শুধু শহরেই তাদের সেবা দান সীমাবদ্ধ রাখেননি।
তাঁরা রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি, রাউজান, পটিয়া এমনকি বাঁশখালীর প্রত্যন্ত গ্রামেও খাদ্য সামগ্রী, কম্বল, মাস্ক ইত্যাদি বিতরণ করেছেন। এ ব্যাপারে দৈনিক আজাদীও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। আজাদী কর্তৃপক্ষ লায়ন্স ক্লাবকে প্রয়োজনীয় মাস্ক দিয়ে সহায়তা করেছেন। তাছাড়া রাঙ্গুনিয়াতে চক্ষু শিবির এর মাধ্যমে গরীব রোগীদের বিনামূল্যে চক্ষু পরীক্ষা এবং প্রয়োজনে খুলশীতে লায়ন্স চক্ষু হাসপাতাল এ অস্ত্রোপচারসহ প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করেছেন। হিমোফ্লিয়া সোসাইটি চট্টগ্রামকে লায়ন্সের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় কমিপউটারও প্রদান করা হয়। লায়ন নাজমুল কবির খোকন যখন করোনা আক্রান্ত হয় তখন চট্টগ্রামের সকল ক্লাবের লায়নরা এবং লায়ন জেলা নেতৃবৃন্দ সর্বক্ষণ মা ও শিশু হাসপাতালে তিনি এবং তাঁর পরিবারের পাশে ছিলেন। এমনকি তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনে প্রাক্তন গভর্নর কামরুন মালেককে কাঁদতে দেখেছি। লায়নদের মধ্যে এই যে ভাতৃত্ববোধ -তা বিরল।
লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেখানে প্রায় ৪৭০০০ ক্লাবে প্রায় ১৫,০০,০০০ মত সদস্য। বিশ্বের প্রায় দুইশটি দেশে লায়ন্সের সেবা বিস্তৃত যা ১৯১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়। মেলভিন জোনস লায়নিজমের জনক। প্রথমদিকে লায়ন্সরা অন্ধত্ব দূরীকরণে কাজ করলেও বর্তমানে পরিবেশ সুরক্ষা ও অভুক্তদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ, শিক্ষা, চিকিৎসা, বয়স্ক ও পঙ্গুদের সাহায্য ইত্যাদি ক্ষেত্রেও অবদান রেখে চলেছে। লায়ন্স এর গড়ঃঃড় হচ্ছে ডব ঝবৎাব. লায়ন্স গ্লোবাল সেবার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে স্থানীয়দের সাহায্যের জন্য যে সেবার প্রয়োজন তা দিয়ে থাকেন। সেবার মাধ্যমে ক্লাব সদস্যরা নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং সহমর্মিতার বন্ধনে আবদ্ধ হন যেখানে কোন বর্ণ, ধর্ম বা রাজনীতিক কোন ভেদাভেদ থাকে না। মানবতার সেবাই হল আসল উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশ লায়নিজমের এর প্রবক্তা হলেন প্রয়াত এম আর সিদ্দিকী। তাঁর হাত ধরে বাংলাদেশে লায়নিজমের শুভ সূচনা। বর্তমানে লায়নিজমের বাংলাদেশে নেতৃত্বে আছেন যোগ্য নেতা আন্তর্জাতিক পরিচালক কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ। লায়নিজম তরুণদের সেবার মাধ্যমে নেতৃত্বের গুণাবলী সৃষ্টি করে। যাতে তারা ভবিষ্যতে দেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে তাই আমরা আশাবাদী করোনার এই অতিমারিতে যেমন সেবার ব্রত নিয়ে এগিয়ে এসেছে ভবিষ্যতেও যেকোন মহামারী বা দুর্যোগে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এগিয়ে আসবে।
লেখক : প্রবন্ধকার, সংগঠক ও সাবেক ব্যাংকার।