আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। একুশের গানের অমর স্রষ্টা। লেখার সূচনা তাঁর মন্তব্য দিয়েই করতে চাই। ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় একুশের বিশেষ প্রতিবেদন। বাংলা ভাষা ও একুশের আবেদন এর ওপর প্রতিবেদন। গাফ্ফার চৌধুরী প্রতিক্রিয়ায় বললেন, “একুশে ফেব্রুয়ারির অনেক বিবর্তন ঘটে গেছে। শোকের দিনটিকে এখন উৎসবের দিনে পরিণত করা হয়েছে। ধিক্কার দেই, প্রতিবাদ করেছি। কেউ তো শুনে না। এই আলামত তো ভাল না। অবিলম্বেই সরকারের কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। একুশের মূল সুর আবেদন আমাদের ধরে রাখতে হবে। ” একুশ এভাবে মূলধারা থেকে যাবার আশঙ্কা কেবল নয় হৃদয় দিয়ে আমরা অনুভব করি যে, একুশের গৌরবের ইতিহাসকেও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং একাধিকবার একুশের ইতিহাসের খণ্ডিত বর্ণনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বায়ান্নর একুশের আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা আড়াল করার প্রবণতা নিয়েই সমালোচনা শেখ হাসিনার। একুশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার গুরুত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ২০২১ সালের একুশের প্রাক্কালে আমাদের আবেগ, অনুভূতি সেই কথারই প্রতিধ্বনি করছে। একুশকে সংহত করতে চাই পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। যেটা বাঙালিকে নিয়ে গেছে বিশ্বে অনন্য উচ্চতায়। আমরা পেয়েছি বীরের তগ্মা। কেবল আমরাই মাতৃভাষার জন্য আত্মদানকারী জাতি।
বায়ান্নর একুশের আন্দোলনে ঢাকার রাজপথ আর চট্টগ্রাম একাকার ছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮ সালের পর থেকে ধারাবাহিক আন্দোলনে ছিল চট্টগ্রাম। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামেও হরতালে ছিল উত্তাল। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি, ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে গুলির প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে। ঐ দিনের লালদীঘি ময়দানের সমাবেশ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে হরতাল ও লালদীঘি ময়দানে জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। স্মৃতিচারণ ও ভাষা সংগ্রামীদের বর্ণনায় এসেছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। প্রথমে মফিজুল ইসলামকে আহবায়ক করা হয়। পরে তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম. এ. আজিজকে আহবায়ক করা হয়েছিল। পক্ষান্তরে ভাষা আন্দোলনে কেন্দ্রীয়ভাবে নেতৃত্বে থাকা তমদ্দুন মসজিলের প্রকৌশলী আজিজুর রহমান। তাঁরা আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করছিলেন। সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ এবং মাহবুব উল আলম চৌধুরী। মতান্তরে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক ছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল হারুন, মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী, রফিকুল্লাহ চৌধুরী, ডা. সৈয়দুর রহমান চৌধুরী, কৃষ্ণ গোপাল সেন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। যাদের কেউ এখন বেঁচে নেই। এ আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মী, রেল শ্রমিকদের ভূমিকা ছিল প্রণিধানযোগ্য। বিশেষ করে ১৯৫১ সালের মার্চে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সম্মেলন ভাষা আন্দোলনে প্রভাব ফেলেছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি ও হত্যাকাণ্ডের খবরে বারুদের মতো জ্বলে উঠেছিল চট্টগ্রাম। সর্বদলীয় সমাবেশ ডাকা হয় লালদীঘি মাঠে। হরতালে অচল হয়ে পড়ে চট্টগ্রাম। হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে অসুস্থ মাহবুব আলম চৌধুরী রচনা করেন ঐতিহাসিক এক আগুন ঝরা কবিতা। ছন্দ পরিণত হয় বুলেটে। “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি” শিরোনামের কবিতাটি রাতারাতি ছাপার ব্যবস্থা করা হয়। মাতৃভাষার দাবিতে এটি চট্টগ্রামে একুশের প্রথম সংকলন। চট্টগ্রামের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেস স্থাপন করেছিলেন।
তখনকার সময়ে এইটিই চট্টগ্রামে আধুনিক ছাপাখানা। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার এর সম্মতিতেই একুশের রাতেই কোহিনূর প্রেসে গোপনে চলে মাহবুব আলম চৌধুরীর কবিতা ছাপার কাজ। কোহিনূর প্রেসের তৎকালীন ম্যানেজার দবির উদ্দিন চৌধুরী, কম্পোজিটার ও মেশিনম্যান দ্রুততার সাথে ছেপে দেন এই কবিতা। এই কবিতা ভাষা আন্দোলনের অগ্নি স্ফুলিংগ ছড়িয়ে দেয়। সরকার হয়ে ওঠে আরো মারমুখী। ছাপা’র অক্ষরে আসায় আরো রুদ্রমূর্তি ধারণ করে পাক সরকার। রাজরোষের কবলে পড়ে আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস। সীলগালা করে দেয়া হয় তাৎক্ষণিকভাবে। গ্রেপ্তার করা হয় প্রেস ম্যানেজার দবির উদ্দিন চৌধুরীকে। বিচারে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। তবে, নানামুখী চেষ্টায় কয়েক মাস পর তাকে মুক্ত করা হয়। মাহবুব উল আলম চৌধুরী অসুস্থ থাকায় ২২ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি মাঠে সর্বদলীয় জনসভায় সেদিন কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি কবিতা পাঠ করেছিলেন শ্রমিক নেতা ও সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহবায়ক চৌধুরী হারুনুর রশীদ। লালদীঘিতে সেদিন হয়েছিল প্রতিবাদী মানুষের হাজারো সমাবেশ। লালদীঘি মাঠের সংলগ্ন (বর্তমানে যেখানে পেট্রোল পাম্প রয়েছে।) ভিক্টোরিয়া পার্কেই চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়েছিল।
২২ ফেব্রুয়ারি জনসভায় আগতরা সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। অবশ্য দুইদিন পর পুলিশ এই শহীদ বেদীটি গুঁড়িয়ে দেয়। কোহিনূর প্রেসের উপর নিষেধাজ্ঞায় ভেঙে পড়েননি আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার। কিছু দিনের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। প্রেস ম্যানেজার দবির উদ্দিন চৌধুরীকে শুধু আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার নন তাঁর সুযোগ্য পুত্র এম. এ মালেক সারাজীবনই কোহিনূর এর সাথে রেখেছিলেন। আমার সাথে তাঁর আলাপ কোহিনূর লাইব্রেরীর যখন দায়িত্বে ছিলেন। আমিও তখন কোহিনূর লাইব্রেরীর উপর তলার বাসিন্দা। আজাদীর তৎকালীন পরিচালনা সম্পাদক বর্তমান সম্পাদক এম. এ মালেকের বদান্যতায় আমার মাথা গুঁজার ঠাঁই হয় একটি কক্ষে। আমার সাথে দবির উদ্দিনের আলাপচারিতায় তাঁর স্মৃতিচারণ ছিল আমার জন্য শিক্ষণীয়। স্মৃতি রোমন্থনে তিনি বেশ গর্ব করে বলতেন এই ভাষার মর্যাদার জন্য আমারও জেলে যাবার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁর অহংকারে আপ্লুত হয়েছি। এখনো স্মরণে যা আমাকে দীপ্ত করে। ভাষা আন্দোলনে যারা চট্টগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের প্রায় সবাই আজ আর নেই। দবির উদ্দিন চৌধুরীও নেই। সেই সাহসী, ভাষা প্রেমী আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারও। মাহবুব উল আলম চৌধুরীও না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। কালের সাক্ষী হয়ে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস। জানান দেয় একুশের অনন্য অবদানের। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের।
ইতিহাসের এই অনবদ্য ভূমিকার অংশীদার কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস অদ্যাবধি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বঞ্চিত রয়েছে। গৌরবদীপ্ত ইতিহাসকে অমলিন রাখার স্বার্থেই এ স্বীকৃতির প্রয়োজন অপরিহার্য। প্রজন্মের পর প্রজন্মের ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস জানার জন্য সহায়ক হবে এ স্বীকৃতি। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির স্মারক হয়েই থাকবে চিরদিন। ভাষা আন্দোলনের বীরত্বগাথা, ত্যাগের ইতিহাস চর্চায় ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর ১০০ দিনের কর্মসূচিতে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নিয়ে যে কমপ্লেঙ পরিকল্পনা সিটি কর্পোরেশনের ছিল তা ফাইলবন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করা গেলে ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার দ্বার উন্মুক্ত হবে। ইতিহাস এবং ভাষা চর্চায় এ মুহূর্তে সময়োপযোগী উদ্যোগটি প্রয়োজন। আমাদের ইতিহাসের পূর্ণতা বাঙালিরই অহংকারকে জাগরুক রাখবে চিরদিন।