আমরা জানি বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে বাংলা ভাষার প্রতি অকৃত্তিম ভালবাসা পোষণ করতেন এবং সুযোগ পেলেই তার বহি:প্রকাশ ঘটাতেন। বৃটিশ আমলে ছাত্রাবস্থায় তিনি ১৯৪৬ দিল্লী মুসলিম লীগ সম্মেলনে বাংলাতে স্লোগান দিতে দিতে দলবলসহ যোগ দিয়েছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে পিকেটিং করতে গিয়ে কারাবরণ করেছিলেন এবং আন্দোলনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিলেন। ৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে ঢাকা জেল থেকে তাকে চিকিৎসার জন্য যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালে আনা হয় তখন তিনি সেখানেও ছাত্রলীগের ছেলেদের সাথে বৈঠক করে ভাষা আন্দোলনে করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ৫৪ সালের নির্বাচনে যে ২১ দফা রচিত হয় তার অন্যতম কারিগর ছিলেন আবুল মনসুরসহ বঙ্গবন্ধু। ২১ দফা দাবির ৯ নং দাবিতে প্রাথমিক ও অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা ছিল, ১০ নং দাবিতে মাতৃভাষায় শিক্ষা দানের ব্যবস্থার উল্লেখ ছিল। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের বাইরে ও ভিতরে ২১ দফা বাস্তবায়নের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পাকিস্তান আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষার মুদ্রণের দাবি জানান। ৫৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি খসড়া শাসনতন্ত্রে সরকারি ভাষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘ পূর্ব বঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যে সব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা কুমতলবে করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোন ধোকাবাজি চলবে না। বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করা হোক।’ ১৬ ফেব্রুয়ারি অধিবেশনেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। তিনি সরকারি ভাষা ও রাষ্ট্র ভাষার মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করেছিলেন। রাষ্ট্রভাষার মানে দেশের সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাসহ সব কাজে বাংলার ব্যবহার হবে। এ দিন বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাংলাভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে সমসাময়িক যে কোন নেতার চাইতে বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল অনেক বেশী।
১৯৬২ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে বলা হয় উর্দুকে জনগণের ভাষায় পরিণত করতে হবে, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা করলে তা আরবীতে করা যুক্তিসংগত, উর্দু ও বাংলা বর্ণ মালা সংস্কার করে তা রোমান বর্ণমালায় অক্ষরান্ত করার চিন্তা করতে হবে, অবৈতনিক শিক্ষা তুলে দিতে হবে, শিক্ষাকে পণ্য হিসাবে বিবেচনা করতে হবে ইত্যাদি। এর বিরুদ্ধে ৬২ সালে যে শিক্ষা আন্দোলন হয় তার অনুঘটক ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৬৯ সালের ১১ দফার ১/গ দাবিতে ছিল: শাসকগোষ্ঠীর শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রামাণ্য দলিল ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট’ ও ‘হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট’ বাতিল করতে হবে এবং ছাত্রসমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে গণমুখী ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থা কয়েম করতে হবে। বঙ্গবন্ধু ১১ দফার একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। আওয়ামীলীগ ১৯৬৯ সালে মার্চে কর্মসূচিতে সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করে যে চূড়ান্ত কর্মসূচি দেয় তাতে ছিল: পাকিস্তানের সব অঞ্চলে মাতৃভাষাকে শিক্ষার সর্বোচ্চ মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলাভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রচলন করতে হবে, ব্যবসা বাণিজ্যসহ জীবন যাপনের সর্বক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যে দিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করব, একেবারে শুদ্ধ বাংলা দিয়ে চালু করতে গেলে বাংলা ভাষা আর চালু করা যাবে না, প্রয়োজনে ভুল বাংলা দিয়েই চালু করব। পন্ডিতেরা ধীরে ধীরে তা সংশোধন করে দেবেন’। ’৭১ সালের ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহারে বাংলাদেশ অর্জনের যে তিনটি লক্ষ্য ঘোষিত হয়েছিল তার প্রথমটি ছিল, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ জাতি সৃষ্টি ও বাঙালির ভাষা সাহিত্য কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। মূলত ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় যার স্রষ্টা হলেন বঙ্গবন্ধু।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব গণপরিষদে যে সংবিধান পাশ করা হয় সেই সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে‘ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। মনে রাখতে হবে বাংলা কেবল সরকারি ভাষা নয়, রাষ্ট্রভাষা।
৭৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু তার বাণীতে বলেন, শহীদের আত্মাহুতি বৃথা যেতে দিব না, এই দিনটি জাতির আত্মশুদ্ধির দিন, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলাভাষার ব্যবহার জাতিকে সবক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যাক এটা হোক কামনা।
৭৪ সালের ২৫ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলাভাষায় বক্তৃতা দিয়ে বাংলাভাষাকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগে রাশিয়াতে গিয়েও বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশে বাংলার প্রচলন হয়নি।
এর প্রেক্ষাপটে ৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারি অফিস আদালতের দাপ্তরিক কাজে বাংলাভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারী করেন, আদেশে বলা হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা,বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা, তবু অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে, মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই দেশের প্রতি তার ভালবাসা আছে একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’এরপরও প্রশাসনে লুকিয়ে থাকা বাংলা বিরোধী শক্তি বাংলা প্রচলন করেনি।
এরপর ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ বাংলাভাষা প্রচলন আইন পাশ হয়। আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় একটি রিটের প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মহামান্য হাইকোর্ট বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ এর বাস্তবায়নের আদেশ দেয়। আইনের ধারা- উপধারা ও আদালতের নির্দেশের সারাংশ হলো: সকল অফিস আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার করতে হবে, সকল প্রতিষ্ঠানের নাম ফলক, বিজ্ঞাপন বাংলাভাষায় হতে হবে। কোন সরকারি কর্মকর্তা এই আইন না মানলে তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
নামফলকে ইংরেজির প্রাধান্য, বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান এমনকি কিছু সরকারি দফতরেও ইংরেজির প্রাধান্য , অসংখ্য টেলিভিশন চ্যানেলের ইংরেজি নাম, ইংরেজি বিজ্ঞাপন, উচ্চ আদালতে ইংরেজির ব্যবহার, উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার প্রচলন না হওয়া- সব কিছুই বঙ্গবন্ধু আজীবন লালিত স্বপ্নকে যেন ব্যঙ্গ করছে। এই কারণে কোন সরকারি কর্মকর্তার শাস্তি হয়নি। দু:খজনক ব্যাপার হলো দীর্ঘ বছর বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও বিষয়টি গুরুত্বহীন বলেই বিবেচিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্ন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বাংলাদেশ আজো অধরাই রয়ে গেল।
তো এতো আইন ও প্রচেষ্টার পরও বাংলা কেন রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পচ্ছে না, কেবল সরকারি ভাষা হিসেবেই কেন রয়ে গেল? আমাদের অনেকের ধারণা স্বাধীনতার পর আমরা বাংলাভাষা প্রচলনের দায়িত্ব সরকারের উপর ছেড়ে দিয়ে বসে ছিলাম। ৫০ বছরেও দেশে বাংলাভাষার পক্ষে কোন জন দাবি আসেনি। ফলে আইন আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করা স্বার্থাম্বেষী মহলের পক্ষে সহজেই সম্ভব হয়েছে এবং হচ্ছে।
এবার আমাদের কয়েকজনের কথায় আসি। ২০১৬ সাল থেকে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি সামাজিক সংগঠন মিলে আইন ও আদালতের নির্দেশ মেনে অন্তত নামফলকের উপরের ৬০ ভাগে বাংলা ও নীচের ৪০ ভাগে ইংরেজীসহ যে কোন বিজাতীয় ভাষা লেখার অনুরোধ জানিয়ে রাস্তায় শ’খানেকের উপর মিছিল ও পথসভা করেছি, বিভিন্ন স্থানে সেই ৬০ দশকের মতো ইংরেজি নাম ফলকের উপর কালো কালি মেরেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্মারক লিপি দিয়েছি। মেয়র আজম নাসির ও প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনকে স্মারক লিপি দিয়েছি। এই সময়ের সব জেলা প্রশাসক, সব পুলিশ কমিশনারকে আইন বাস্তবায়নের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী ছাড়া সবার সাথে দেখা করেছি। সবাই ইতিবাচক কথা বলেছেন। আ জ ম নাসির ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে একবার কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছিলেন, কিছু সাইন বোর্ডের উপর কালি লেপন করেছিলেন। প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বিষয়টিকে গ্রাহ্যেই নেননি। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কমিশনাররা কোন ব্যবস্থা নেননি। সরকার ও প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বাংলা প্রচলন এমনকি নামফলকে বাংলা প্রচলনের ব্যাপারে নির্বিকার। এবারেও সিটি কর্পোরেশনের ১০০ দিনের কর্মসূচিতে বাংলা ভাষার বিষয়টি আসেনি।
সরকার, প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশনের মনোভাবে আমরা হতাশ। এর মাঝেই বাংলা ভাষাকে জীবনের সবস্তরে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন চালাতে হবে। সে আন্দোলন ৫ বছর পর কোন পথে এগোবে তাই নিয়ে ভাবনা।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম- মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট-চট্টগ্রাম। যুদ্ধকালীন চট্টগ্রাম শহর বিএলএফ একটি দলের দলনেতা ও যৌথ কমান্ডের সদস্য।